সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই দেখা যায়, রবি দুহাতে আঁকড়ে ধরেছে তার মণিমাকে, কাঁধে মাথা রেখেছে। বলছে–রোজ রাতে আমি তোমাকে স্বপ্ন দেখে মণিমা।
ফুলির বুকে বোধহয় এই কথায় একটা ঢেউ উঠে নতুন করে। সেই ঘুনধুনে আদরের শব্দটা করতে করতে পিষে ফেলে রবিকে। আর রবি এবার নির্লজ্জের মতো আদর খায়।
ফুলির ছেলেপুলেরা সাড়া পেয়ে হইহই করে এসে ঘিরে ধরে রবিকে। রবি ওদের কাছে একটা বিরাট বিস্ময়। সে সাহেবদের মতো চমৎকার ইংরেজি বলে, অদ্ভুত সব দামি পোশাক পরে, নিখুঁত সহবত মেনে চলে। ফুলির ছেলেমেয়েরা এ সব দেখে ভারী মজা পায়।
ফুলি তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে রবিকে ছেড়ে দিয়ে মুগ্ধচোখে একটু চেয়ে রইল, আপন মনেই বলল, রোগা হয়ে গেছে।
চাঁপা হটবক্স ফ্লাক্স আর দই মিষ্টির ভাঁড় নামিয়ে রাখতে রাখতে বলে, কিছু খেতে চায় না।
ফুলি মাথা নেড়ে বলে, খাবে কী? ওর ভিতরটা যে খাক হয়ে যায়। সে আমি বুঝি।
ফুলিদের আলাদা বসবার ঘর নেই। ঢুকতেই একটা লম্বাটে দরদালানের মতো আছে, সেখানে কয়েকখানা চেয়ার পাতা। ফুলির বর শিশির বি-এন-আর-এ চাকরি করে। বয়স বেশি নয়, কিন্তু ভারী প্রাচীনপন্থী। বছর বছর ছেলেপুলে হয় বলে দেবাশিস ওকে একবার বলেছিল ভায়া, বউটাকে তো মেরে ফেলবে, ছেলেপুলেগুলোও মানুষ হবে না।
শিশির একটু ঘাড় তেড়া করে বলল, তা কী করব বলুন?
তখন দেবাশিস বলে, কন্ট্রাসেপটিভ ব্যবহার করো না কেন?
শুনে বড় রেগে গিয়েছিল শিশির, বলল, কেন, আমি কি নষ্ট মেয়েমানুষের কাছে যাচ্ছি নাকি যে ও সব ব্যবহার করব?
এই হচ্ছে শিশির। আধুনিক জগতের কোনও খোঁজই সে রাখে না, তার ধারণা চাঁদে মানুষ যাওয়ার ঘটনাটা স্রেফ কারসাজি আর পাবলিসিটি। আজও সে বিশ্বাস করে না যে চাঁদে মানুষ গেছে। কথা উঠলেই বিজ্ঞের মতো একটা স্থ’ দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দেবাশিসকে সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। দেবাশিসের অর্থকরী সাফল্যকে সে হয়তো ঈর্ষা করে, কিংবা তার আধুনিক ফ্যাশনদুরস্ত হাবভাব, চালাক চতুর কথাবার্তা অপছন্দ করে।
দেবাশিস দরদালানের চেয়ারে বসল একটু। ভিতরের ঘরে রবিকে ঘিরে ধরে পিসতুতো ভাইবোন হল্লা করছে। মুর্গ-মুসল্লমের প্যাকেট হটবক্স থেকে বের করা হয়েছে বোধ হয়। তাই দেখে চেচাচ্ছে ফুলির আনন্দিত ছেলেমেয়েরা। বাথরুমের দিক থেকে গামছা-পরা শিশির বের হয়ে এল। দেবাশিসকে দেখে একটু হাসল। বলল, কী খবর? হাসিটা তেমন খুলল না।
এই তো, চলে যাচ্ছে।
রবিকে এনেছেন?
হ্যাঁ, আওয়াজ পাচ্ছ না?
শিশির এবার সত্যিকারের হাসি হাসল। দেবাশিসকে যতই অপছন্দ করুক শিশির, রবির প্রতি তারও ভয়ঙ্কর টান আছে! রবি এলে সে রসগোল্লা কিনে আনে, টফি আনে, খেলনা। ডাকে রবিরাজ বলে।
ফুলি এক কাপ চা হাতে এল। শিশিরকে দেখে ঘোমটা দিল মাথায়। ওর চালচলনে এখনই কেমন গিন্নি বান্নির ঠাট-ঠমক পাকা হয়ে গেছে। একগাল পান মুখে।
চা-টা একটা ছোট্ট টুলে দেবাশিসের সামনে রেখে হাঁসফাঁস করতে করতে বলে, সুজি করেছি, খাবে?
না।
পানের পিক ফেলতে বাথরুমে মুখ বাড়িয়ে আবার ফিরে এল ফুলি। চাঁপার দিকে চেয়ে বলল, তুই দিনমান থাকবি তো চাঁপা, না কি দাদার সঙ্গে চলে যাবি? আমি একহাতে আজকের দিনটা সামলাতে পারি না। খুদে ডাকাতরা সারা বাড়ি তছনছ করে, তার ওপর আজ আবার ওদের বাপ শনিঠাকুরটি বাড়িতে আছেন। আমি বলি বরং তুই থেকে যা।
চাঁপা ঘাড় নাড়ল। বলে, সোনাবাবুর কাছছাড়া হতে ভাল লাগে না।
মুখটা খুশিতে ভরে ওঠে ফুলির, বলে, আহা, রোগা হয়ে গেছে।
দেবাশিস ভদ্রতাবশত চায়ে চুমুক দেয়। আসলে ফুলির বাসার চা সে খেতে পারে না। চায়ের সুঘ্রাণ নেই, আছে কেবল লিকার আর গুচ্ছের দুধ-চিনি। দুধ বেশি পড়ে গেছে, ফলে চা সাদা দেখাচ্ছে। ছেলেবেলায় বেশি দুধের চাকে তারা বলত সাহেব চা। সাহেবদের রং ফরসা বলেই বোধ হয় উপমাটা দিয়ে থাকবে।
ফুলি, এ যে সাহেব চা! দেবাশিস বলে।
ফুলি প্রথমটায় বুঝতে পারে না। তারপর বুঝে লজ্জা পেয়ে বলে, তোমার তো আবার সব সাহেবি ব্যাপার। পাতলা লিকার অল্প দুধ-চিনি ও সব কি আর মনে থাকে! আমাদের বাঙালি বাড়িতে যেমনটি হয় তেমনটি করে দিয়েছি। আবার করে দিই।
থাকগে। খারাপ লাগছে না। দেবাশিস বলে।
ফুলি সামনে মোড়া পেতে বসল। গায়ে মোটা মোটা গয়না, আঁচলে চাবি, সব মিলিয়ে ওর নড়াচড়ায় এক ঝনৎকার শব্দ হয়। জোরে শ্বাস ফেলে, খাসের সঙ্গে একটা শারীরিক কষ্টে ওঃ বা আঃ শব্দ করে। সম্ভবত কোনও মেয়েলি রোগ আছে। শরীরের নানা আধি-ব্যাধির কথা বলে, কিন্তু বসে শুয়ে থাকে না কখনও। সারাদিন কাজকর্ম করছে স্টিমরোলারের মতো।
বসে ফুলি বলল, দাদা, এবার রবির ব্যাপারে একটা কিছু ঠিক করো।
কী ঠিক করব?
ওকে আর তোমার ফাঁকা ভুতুড়ে ফ্ল্যাটে রেখে লাভ কী? সারাদিন ওর মনের মধ্যে নানা ভয়-ভীতি খোঁড়ে। দেখছ না, কেমন রোগা হয়ে যাচ্ছে। খাওয়ায় অরুচি, সারাদিন নাকি মুখ গোমড়া করে থাকে। সঙ্গী-সাথিও নেই।
সব সয়ে যাবে।
সইছে কোথায়! প্রায় সময়েই আমার কাছে এসে মায়ের কথা বলে। দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে রাখি, ঘুমের মধ্যে দেখি খুব চমকে চমকে ওঠে। এ সব ভাল লক্ষণ নয়। মুখে কিছু বলে না, লজ্জায়। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কাঁদে।