তা জানি। আমি তবু একটা কথা জানতে চাই। তোমার চোখে এখন আমি কীরকম? শচীন হাসল না। তবু একটু দুর্বোধ্য কৌতুক চিকমিক করে গেল তার চোখে। বলল, অ্যাপারেন্টলি তুমি তো এখনও বেশ সুন্দরীই। ফিগার ভাল, ছেলেমেয়ের মা বলে বোঝা যায় না।
তৃণা রেগে লাল হয়ে গেল। বলল, সে কথা জিজ্ঞেস করিনি।
তবে?
আমি জানতে চাইছি, তুমি আমাকে কী চোখে দেখ!
ও। বলে শচীন তেমনই চুপ করে চেয়ে থাকে তার দিকে। চোখে কোনও ভাষা নেই, নীরব কৌতুক ছাড়া। বলে, তোমাকে আসলে আমি দেখিই না। অনেক চেষ্টা করে তবে এই না-দেখার অভ্যাস করেছি।
তৃণার এ সবই জানা। তবু বলল, এই যেমন এখন দেখছ! এখন কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না?
হচ্ছে।
সেটা কেমন?
রাস্তার ভিখিরিদের আমরা লক্ষ করি না। আবার তাদের মধ্যে কেউ যখন সাহসী হয়ে, কিংবা মরিয়া হয়ে কাছে এসে তাদের দুঃখের কথা বলে তখন তাকে দেখি, মায়া হয়, করুণা বোধ করি। এও ঠিক তেমনি, তোমার জন্য মায়া এবং করুণা হচ্ছে। আবার যখন ভিখিরিটা দঙ্গলে মিশে যাবে, তখন আবার তাকে লক্ষ করব না। আমরা কেউ কাউকে কনস্ট্যান্ট মনে রাখতে পারি না, সে যত ভালবাসার বা ঘেন্নার লোক হোক না কেন। কখনও মনে রাখি আবার ভুলে যাই, ফের মনে করি এমনিভাবেই সম্পর্ক রাখি। মানুষ দুভাবে থাকে।
সে কেমন?
এক, কেবলমাত্র শারীরিকভাবে থাকে। দুই, মানুষের মনের মধ্যে থাকে। আমার কাছে, তুমি কেবল শারীরিকভাবে আছ, আমার মনের মধ্যে নেই।
তৃণা ভ্রূ কোঁচকায়। বিরক্তিতে নয়, যখন সে খুব অসহায় হয়ে পড়ে তখন কোঁচকানো তার স্বভাব।
তৃণা শ্বাস ফেলে বলে, এটা সত্যি কথা নয়।
তা হলে কোনটা সত্যি কথা? তুমি কি আমার মনের মধ্যে আছ?
তৃণা মাথা নেড়ে বলে, আমি সে কথা বলিনি। আমি জানতে চাই আমাকে–আমার প্রতি তোমার প্রতিক্রিয়া কী?
শচীন মাথাটা নামিয়ে সবুজ টেবিলের ওপর তার দুহাতের আঙুল দেখল। তারপর মুখ না তুলেই বলল, আমি খুব সিমপ্যাথেটিক। তোমার সমস্যাটা আমি বুঝি, তাই তোমাকে সাহসী হতে বলেছিলাম।
আমাকে চলে যেতে বলছ?
শচীন মাথা নেড়ে বলল, না, তুমি এ বাড়িতে থেকেও যা খুশি করতে পারো। তাতে আমাদের যে কিছু আসে যায় না, তা তো তুমি বোঝেই, কিন্তু তোমার তাতে আসে যায়। তুমি কেবলই পাপবোধে কষ্ট পাচ্ছ, আমরা তোমাকে নিয়ে নানা জল্পনা করছি বলে সন্দেহ করছ। হয়তো একথাও ভাব যে, দেবাশিসবাবুর স্ত্রী তোমার জন্য আত্মহত্যা করেন। এ সব তোমার ভিতরে ক্ষয় ধরাচ্ছে। আমি তোমাকে চলে যেতে বলছি না, কিন্তু গেলে তোমার দিক থেকেই ভাল হবে।
আমি থাকি বা যাই, তাতে কি তোমাদের কিছু যায় আসে না?
না।
আর যদি মরে যাই?
সেটা স্বতন্ত্র কথা। অন্য মানুষকে মরতে দেখলে আমাদের নিজের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে, তাই মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু, তুমি মরবে কেন?
আমি ইচ্ছে করে মরব, এমন কথা বলিনি। কিন্তু মনে হয়, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না।
তা হলে সেটা দুঃখের ব্যাপার হবে। যাতে মরতে না হয় এমন কিছু করাই ভাল। শরীর খারাপ হয়ে থাকলে ডাক্তার দেখাও।
তৃণা ঘুরে দরজার দিকে এগোয়। ছিটকিনি খুলতে হাত বাড়িয়ে বলে, দেখাব। কিন্তু দয়া করে মনে কোরো না যে, আমি তোমার বা তোমাদের করুণা পাওয়ার জন্য মরার কথা বলেছিলাম।
শচীন চেয়ার ঠেলে উঠল। কথা বলল না।
তৃণা আর একবারও ফিরে তাকাল না। দরজা খুলে সে বেরিয়ে এল হলঘরে। তারপর সিঁড়ি ভেঙে বাগানের রাস্তা ধরে চলে আসে ফুটপাথে। খুব জোরে হাঁটতে থাকে।
আপন মনেই বিড়বিড় করে কথা বলছিল তৃণা–যাব না কেন? আমি তো তোমাদের কেউ না।
কোনও লক্ষ্য স্থির ছিল না বলে তৃণা ভুল রাস্তায় এসে পড়ল। ঘড়িতে খুব বেশি সময় নেই। দেবাশিস আসবে। ফাঁড়ির কাছের বাসস্টপে তাদের দেখা হবে। দেখা হলেই পৃথিবীর মরা রঙে উজ্জ্বলতা ফুটে উঠবে।
তৃণা ঠিক করে ফেলল, আজ সে দেবাশিসকে বলবে, বরাবরের মতো চলে যাবে তৃণা, ওর কাছে।
সামনেই একটা থেমে-থাকা মোটর সাইকেল স্টার্ট দিচ্ছে অল্পবয়সি একটা ছেলে। স্টার্টারে লাথি মারছে লাফিয়ে উঠে। স্টার্ট নিচ্ছে না গাড়িটা, দু-একবার গরগর করে থেমে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ রাস্তায় শব্দটা ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি হয়ে মস্ত বড় হয়ে যাচ্ছে। সেই শব্দটায় যেন তৃণা সংবিৎ ফিরে পেল। সে। চারধারে তাকিয়ে দেখল এ তার রাস্তা নয়। ফাঁড়ি আরও উত্তরে।
সে ঘুরে হাঁটতে থাকে। পিছনে মোটরসাইকেলটা স্টার্ট নেয় এবং ভয়ঙ্কর একটা শব্দ তুলে মুখ ঘুরিয়ে তেড়ে আসে। ফুটপাথে উঠে যায় তৃণা। মোটর সাইকেলটা ঝোড়ো শব্দ তুলে তাকে পেরিয়ে চলে যায়।
০৫. গাড়ির শব্দ পেয়েই
॥ পাঁচ ॥
গাড়ির শব্দ পেয়েই ওপর থেকে ফুলি হাঁফাতে হাঁফাতে নেমে আসে। অল্পবয়সেই ফুলি বড় মোটা হয়ে গেছে। এক দঙ্গল ছেলেপুলের মা। তবু বোধ হয় সন্তানের তেষ্টা ওর মেটেনি। রবির জন্য একবুক ভালবাসা বয়ে বেড়ায়।
ফুলির আদর সোহাগ সবই সেকেলে ধাঁচের। রবি গাড়ি থেকে নামতে নানামতেই ফুলি হাত বাড়িয়ে রাস্তাতেই ওকে বুকে টেনে নেয়। মৃদু সুখের ঘুনধুনে শব্দ করতে করতে বলে, ধন আমার, মানিক আমার, গোপাল আমার…বলে মুখে বুকে মুখ ড়ুবিয়ে দেয়। রবি প্রথমটায় লজ্জা পায়। হাত-পা দিয়ে আদরটা ঠেকায়। কিন্তু তারও দুর্বলতা আছে। সারা সপ্তাহ ধরে সে এই অদ্ভুত গ্রাম্য আদরটুকুর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে।