তৃণা খুব অসম্ভব একটা চেষ্টায় শচীনের ওপর নিজের চোখ রেখে তাকিয়ে রইল। শচীন খুব গভীর। অন্যমনস্কতা কেটে গেছে। একটি চিন্তিত দেখাচ্ছে মাত্র।
শচীন মাথাটা নেড়ে বলল, যাবে যাও। বলার কী?
এই উত্তরই আশা করেছিল তৃণা। কিন্তু আজ তার একটা মরিয়া ভাব এসেছে। কেবলই মনে হয়েছে টানবাঁধা উদ্বেগ ও শঙ্কায় ভরা এইসব সম্পর্কের ভিতরের সত্যটা তার জেনে নেওয়া দরকার। যেন আর খুব বেশি সময় নেই।
তাই তৃণা বলে, এ ছাড়া তোমার আর কিছু বলার নেই?
শচীন অবাক হয়ে বলে, কী থাকবে? এখন বলাকওয়াব স্টেজ পার হয়ে গেছে।
তৃণা তার শুকনো ঠোঁট বিশুষ্ক দাঁতে চেপে ধরল। মুখে জল নেই, পাপোশের মতো খসখসে লাগছে জিভটা। কিন্তু আশ্চর্য যে বহু দিন পরে শচীনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার বুক কাঁপছে না, ভয়ও হচ্ছে না তেমন।
তৃণা বলে, আমি যদি একেবারে চলে যাই, তা হলেও কিছু বলার নেই।
বলার অনেক কিছু মনে হয়। কিন্তু বলতে ইচ্ছে করে না।
কেন?
বলা মানে কাউকে শোনানো, আমার তো শোনানোর কেউ নেই!
তৃণা চুপ করে থাকে। কান্না আসে, কিন্তু কাঁদে না। তার কান্নার মূল্যই বা কী?
শচীন টেবিল থেকে জলের জগটা তুলে নিয়ে আলগা করে একটু জল খেল। তারপর তৃণার দিকে তাকিয়ে তেমনি চিন্তিত গলায় বলে, তুমি কি একেবারেই যাচ্ছ?
তৃণা কিছু বলল না। দুঃসাহসভরে তাকিয়ে থাকল।
শচীন বলে সিদ্ধান্তটা আরও আগেই নিতে পারতে।
তা হলে কী হত?
তা হলে অন্তত উদ্বেগ আর মানসিক কষ্ট হত না। দেবাশিসবাবুও নিশ্চিন্ত হতে পারতেন।
তৃণা অধৈর্য হয়ে বলে, আমি সে-যাওয়ার কথা বলিনি।
তবে?
আমার মনে হচ্ছে আমি আর বেশি দিন বাঁচব না।
ও। শচীন একটু চুপ করে থাকে। তারপর, যেন বুঝেছে, এমনভাবে মাথা নাড়ল। বলল, তাও মনে হওয়া সম্ভব। বহুকাল ধরেই তোমার নার্ভের ওপর চাপ যাচ্ছে। তার ওপর আছে নিজেকে ক্রমাগত অপরাধী ভেবে যাওয়ার হীনম্মন্যতা! এ অবস্থায় মরতে অনেকেই চাইবে।
তুমি কি সিমপ্যাথি দেখাচ্ছ?
না। কিন্তু তোমাকে সাহসী হতে বলছি। চোরের মতো বেঁচে আছ কেন? যা করেছ তা আরও সাহস আর স্পষ্টতার সঙ্গে করা উচিত ছিল।
কী বলতে চাও তা আরও স্পষ্ট করে বলল।
শচীন তার দিকে ক্ষণকাল চেয়ে রইল, যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না তৃণার এই ব্যবহার। তারপর বলে, এ ঘরটা কথা বলার ঠিক জায়গা নয়। এসো।
বলে শচীন হলঘরের সামনের দিকের ঘরটায় ঢোকে। এই ঘরে পাতা রয়েছে সবুজ রঙের পিংপং টেবিল, ক্যারম, দাবা, দেয়ালে সাজানো টেনিস আর ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট। কাঠের ফ্রেমে গলফ কিট। একধারে জুতোর র্যাক, দেয়াল আলমারিতে সাজানো কয়েকটা বন্দুক, রাইফেল, কয়েকটা ভাল সোফা দেয়ালের সঙ্গে পাতা রয়েছে।
তৃণার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, শচীন তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে একটু আগ্রহ দেখাবে। ঘটনাটা যেন স্বপ্নের মধ্যে ঘটছে। কিন্তু জানে তৃণা, এত কথা বলে এ সমস্যার কোনও সুরাহা হওয়ার নয়।
ঘরটা একটু আবছায়া। শচীন ঢুকে তৃণার ঘরে ঢোকার জন্য অপেক্ষা করল। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিল। পিংপং খেলার জন্য এ ঘরে কয়েকটা খুব বেশি পাওয়ারের আলো লাগানো আছে। শচীন আলো জ্বালে। চোখ ধাঁধানো আলো।
তৃণার মাথার মধ্যে একটা বিকারের ভাব। বন্ধ ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়েই তার মনে হয়, এ ঘরে একটা মিলনান্তক নাটক করার জন্যই শচীন তাকে ডেকে এনেছে। শেষমেশ জড়িয়ে-টড়িয়ে ধরবে না তো! না না, তা হলে সহ্য করতে পারবে না তৃণা। বড় বিতৃষ্ণা হবে তা হলে।
শচীন পিংপং টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ার টেনে বসল, টেবিলের ওপরে সাবধানে নিজের হাত দু’খানার ভর রেখে তৃণার দিকে চেয়ে বলল, এবার বলো।
তৃণা ভ্রূ কুঁচকে বলে, আমি কী বলব?
বলাটা তুমিই শুরু করেছ।
তৃণা একটু থমকে থাকে।
সময় চলে যাচ্ছে। ফাঁড়ির কাছের বাসস্টপে দেবাশিস তার গাড়ি নিয়ে এসে বসে থাকবে। সেটা ভাবতেই তার শরীরে অসুস্থতাকে ভাসিয়ে দিয়ে একটা জোয়ার আসে তীব্র, তীক্ষ্ণ আনন্দের! শচীনের দিকে তাকিয়ে তার এ লোকটাকে সঙ্গ করতে অনিচ্ছা হতে থাকে।
তৃণা শ্বাস ফেলে বলে, আমি বোধ হয় বেশিদিন বাঁচব না।
সেটা হঠাৎ আজ বলছ কেন?
আজ বলছি, আজই মনে হচ্ছে বলে।
শচীন মাথা নেড়ে ধীর স্বরে বলে, যদি মনে হয় তা হলে তার জন্যে আমরা কী করতে পারি?
তৃণা অধৈর্যের গলায় বলে, আমি কিছু করতে বলিনি।
তবে?
তৃণা একটু ভাবে। ঠিকঠাক কথা মনে পড়ে না। হঠাৎ বলে, আমি এ বাড়িতে কী-রকমভাবে আছি তা কি তুমি জানো না?
শচীন চুপ করে চেযে রইল খানিক। তৃণার আজকের সাহসটা বোধহয় তারিফ করল মনে মনে।
তারপর বলল, বাইরে থেকে কেমন আছ তা জানি। কিন্তু মনের ভিতরে কেমন আছ তা কী করে জানব? প্রত্যেক মানুষই দুটো মানুষ।
সে কেমন?
বাইরেরটা আচার-আচরণ করে, সহবত রক্ষা করে, হাসে বা কাঁদে, ভালবাসে ঘেন্না করে। আর ভিতরের মানুষটা এক পাগল। বাইরের জনের সঙ্গে তার মিলমিশ নেই, বনিবনা নেই, একটা আপসরফা হয়তো আছে। সেই ভিতরের মানুষটাকে জেনুইন অন্তর্যামী ছাড়া কেউ জানতে পারে না!
আমি তত্ত্বকথা শুনতে চাই না।
শচীনকে খুব শান্ত ও নিরুদ্বেগ দেখাচ্ছে। এ মানুষটার এই শান্তভাবটা তৃণা কখনও ভাল মনে নিতে পারে না। শচীন শান্তমুখে বলে, তত্ত্বকথা মানেই তো আর পুঁথিপত্রের কথা নয়। জীবন থেকেই তত্ব কিংবা দর্শন আসে। আমি তো স্পষ্ট করেই বলছি যে, তোমার জন্য আমরা কিছু আর করতে পারি না।