নরম বিছানায় মনু তৃণাকে ঝুপ করে নামিয়ে দিয়ে হাসে–দেখলে তো?
তৃণা একটু ক্ষীণ হেসে বলে, নিজের শরীরে অত নজর দিসনা। নিজের নজর সবচেয়ে বেশি লাগে। সবাই আমাকে নজর দেয়। বন্ধুরা আমাকে স্যামসন বলে ডাকে।
বালাই ষাট।
মনু ঠাট্টার হালকা এবং বোকাহাসি হাসে। বলে, চলি?
কোথায় যাবি?
যাওয়ার অনেক জায়গা আছে।
মনু মাথা ঝাঁকায়। দরজার কাছ থেকে একবার সাহেবি কায়দায় হাতটা তোলে। চলে যায়।
মনুর শরীরের সুঘ্রাণ এখনও ভরে আছে তৃণার শাসপ্রশ্বাসে। ছোট থেকেই মনু মোটাসোটা ভারী ছেলে, টেনে ওকে কোলে তুলতে কষ্ট হত। তখন থেকে সবাই ছেলেটাকে নজর দেয়। এখন দেখনসই চেহারা হচ্ছে। পাঁচজনে তাকাবেই তো! ভাবতে এক রকম ভালই লাগে তৃণার। দুঃখ এই যে, ছেলে তার হয়েও তার নয়। একটু বুঝি বা কখনও মনের ভুলে মাকে মা বলে মনে করে। তারপরই আবার আলগা দেয়। দূরের লোক হয়ে যায় সব। তৃণা ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। কত রকম যে ভয় তার! সে চুপ করে শুয়ে মনুর কথা ভাবতে থাকে।
শচীন কোথায় গিয়েছিল, এইমাত্র ফিরে এল। পাশের ঘর থেকে তার সুরহীন গুন গুন ধ্বনি আসে। হলঘরে ঘড়িতে ঘণ্টা বাজছে। ঘোরের মধ্যে শুয়ে থেকে সেই ঘণ্টাধ্বনি শোনে তৃণা। শুনতে শুনতে হঠাৎ চমকে উঠে বলল, এগারোটা না?
বুকের মধ্যে ধুপ ধুপ করে। উত্তেজনায় নয়। হঠাৎ উঠে বসায় বুকে একটা চাপ লেগেছে। বাসস্টপটা খুব দূরে নয়। দেবাশিস এসে অপেক্ষা করবে। নিজের মানুষজনের কাছে বড় পুরনো হয়ে গেছে তৃণা, পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে এমন কাউকে চাই যার কাছে প্রতিদিন তৃণার জন্ম হয়।
সে উঠল। শরীর ভাল নেই। মন ভাল নেই। এই ভরদুপুরে সে যদি বেরিয়ে যায়, অনেকক্ষণ ফিরে আসে তবু কারও কোনও উদ্বেগ থাকবে না। কেউ একফোঁটা চিন্তা করবে না তৃণার জন্য।
হলঘর থেকে রেবার উচ্চকিত স্বর পাওয়া গেল— বাপি!
শচীন গভীর স্বরে জবাব দেয়— হুঁ!
আমি বেরোচ্ছি।
আচ্ছা।
শচীন তার দাঁড়ে সব পাখিকে শেকল পরাতে পেরেছে। এ সংসারে তৃণার মতো পরাজিত কেউ না। শচীন একই সঙ্গে ছেলেমেয়ের মা ও বাবা, ওরা কোথায় কি যায় কী করে, তা তৃণার জানা নেই। যেমন, আজ দুপুরে কে কে বাড়িতে খাবে, বা কার বাইরে নিমন্ত্রণ আছে, তা সে জানে না। কেউ বলে না কিছু। যা বলে তা শচীনকে। একা, অভিমানে তৃণার ঠোঁট ফোলে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে তার কোঁচকানো শাড়িটা ঠিকঠাক করে নেয়, বেরোবে।
বেরোবার মুখে সে হলঘর পেরোতে গিয়ে দেখে শচীন টবে গাছগুলি ঝুঁকে দেখছে। তৃণার দিকে পিছন ফেরানো। চল্লিশের কিছু ওপরে ওর বয়স, স্বাস্থ্য ভাল। তবু ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গির মধ্যে একজন বৃদ্ধের ভাবভঙ্গি লক্ষ করা যায়। কিছু ধীরস্থির, চিন্তামগ্ন বিবেচকের মতো দেখতে, পাকা সংসারীর ছাপ চেহারায়।
তৃণা নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছিল। শচীনের টের পাওয়ার কথা নয়। তবু শচীন টের পেল। হঠাৎ বুকে কী একটা তুলে নিয়ে ফিরে সোজা তার দিকে তাকাল। হাতে একটা ছোট্ট রুমাল। তৃণার।
শচীন জিজ্ঞেস করে–এটা তোমার?
খুব সুক্ষ্ম কাপড় আর লেস দিয়ে তৈরি রুমালটা তারই। সোফায় বসে থাকার সময়ে পড়ে গিয়ে থাকবে।
তৃণা মাথা নাড়ল।
এখানে গাছের গোড়ায় পড়ে ছিল। বলে শচীন রুমালটা সোফার ওপর আলতোভাবে রেখে দিয়ে আবার গাছ দেখতে লাগল। জাপান থেকে বেঁটে গাছ আনাচ্ছে, শুনেছে তৃণা। সে গাছ কাচের বাক্সে। হলঘরে রাখা হবে। বোধ হয় সে ব্যাপারেই কোনও প্ল্যান করছে।
রুমালটা তুলে নিতে গিয়ে তৃণাকে শচীনের খুব কাছে চলে যেতে হল। তার শ্বাস প্রশ্বাস, গায়ের গন্ধ ও উত্তাপের পরিমণ্ডলটির ভিতরেই বোধ হয় চলে যেতে হল তাকে। তৃণা নিজের শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ টের পায়। অবশ্য শচীন খুবই অন্যমনস্ক। সে মোটে লক্ষই করল না তাকে।
তৃণা রুমালটা তুলে নিল। চলে যাচ্ছিল সিঁড়ির দিকে। হঠাৎ দাঁড়াল, তার কিছু হারাবার ভয় নেই, কিন্তু পাওয়ার আশাও নেই। তা হলে রেবা আর মনুর পর এ লোকটাকে একটু পরীক্ষা করে দেখলে কেমন হয়? বেশ কিছুদিন আগে শচীন তাকে মেরেছিল। জীবনে ওই একবারই বোধহয় পদস্খলন হয়ে থাকবে লোকটার। তা ছাড়া আর কখনও তৃণার জন্য বোধ হয় কোনও আবেগ বোধ করেনি। শচীনের ওই মারটা একটা সুখস্মৃতির মতো কেন যে।
তৃণা আচমকা বলে, আমি যাচ্ছি।
শচীন শুনতে পেল না।
তৃণা মরিয়া হয়ে বলে, শুনছ!
অন্যমনস্ক শচীন দীর্ঘ উত্তর দেয়— উঁ…উঁ!
তারপর ধীরে ফিরে তাকায়। সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ে মগ্ন চোখ!
আমি একটু বেরোচ্ছি। তৃণা হাঁফধরা গলায় বলে।
শচীন বড় অবাক হয় বুঝি! বিস্ফারিত চোখে তার রাঙা পোশাকপরা চেহারাটা দেখে। অনেকক্ষণ পরে বলে, ওঃ!
শচীনের উত্তেজনা কম, রাগ কম। কিন্তু একরকমের কঠিন কর্তব্যনিষ্ঠার বর্ম পরে থাকে। স্ত্রী বিপথগামিনী বলে তার মনে নিশ্চয়ই কিছু প্রতিক্রিয়া হয় কিন্তু তা প্রকাশ করা তার রেওয়াজ নয়, এমন। কী তৃণাকে সে তাড়িয়ে দিতে পারলেও দেয়নি; চমৎকার সুখ-সুবিধের মধ্যে রেখে দিয়েছে। লোকলজ্জাকেও গায়ে মাখে না। এ কেমনতর লোক? এমন হতে পারে, সে তৃণাকে ভালবাসে না, কখনও বাসেনি। কিন্তু ভালবাসুক চাই না বাসুক, পুরুষের অধিকারবোধও কি থাকতে নেই? কিংবা আত্মসম্মানবোধ? তৃণার শরীর ভাল নয়, মাথার ভিতরটাও আজ গোলমেলে। নইলে সে এমন কাণ্ড করতে সাহসই পেত না। সে তো জানে, শচীনের তাকে নিয়ে কিছুমাত্র মাথাব্যথা নেই। সে কোথায় যায় বা না যায় তার খোঁজ কখনও রাখে না।