সে আমি বুঝব।
রেবু, আমার শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে।
ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকে।
তুই অমন করছিস কেন?
রেবা উত্তর না দিয়ে তার ঘরের লাগোয়া নিজস্ব বাথরুমে চলে গেল। সশব্দে দরজা বন্ধ করল। ফাঁকা ঘরে একা তৃণা দাঁড়িয়ে থাকে। সত্যিই তার শরীর খারাপ লাগছিল। খুব খারাপ, যেন বা গা ভরে জ্বর আসছে। চোখে জ্বালা, হাত-পা কিছুই যেন তার বশে নেই। আর মাথার মধ্যে চিন্তার রাজ্যে একটা বিশৃঙ্খলা টের পায় সে। পূর্বাপর কোনও কথাই সাজিয়ে ভাবতে পারে না।
শরীরটা কাঁপছিল, খুব ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে তৃণা। হলঘরে হালকা অন্ধকার। ঠাণ্ডা। একটু দাঁড়ায়, তারপর অবশ হয়ে দেয়ালের গায়ে লাগানো নরম কৌচটায় বসে পড়ে। কৌচের পাশে মস্ত রঙিন কাঠের বাক্সে লাগানো পাতাবাহারের গাছের পাতা তার গাল স্পর্শ করে।
ঝিম মেরে একটুক্ষণ বসে থাকে তৃণা। কতকাল সে তার শরীরের কোনও খোঁজ রাখে না, ভিতরে ভিতরে কী অসুখ তৈরি হয়েছে কে জানে! মাথাটা ঠিক রাখতে পারছে না সে। স্খলিত হয়ে যাচ্ছে স্মৃতি, পারম্পর্যহীন সব এলোমেলো কথা ভেসে আসছে মনে। ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে খুব।
একটা তীব্র শিসের শব্দে সে মুখ তোলে। গায়ে ব্যানলনের দুধসাদা গেঞ্জি, পরনে সু-জিন্স পরা মনু নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে যাচ্ছিল। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ডান হাতের ব্রেসলেটে ঢিলা করে পরা ঘড়িটা দেখল। সময়টা বিশ্বাস হল না বুঝি। তারপর তৃণাকে লক্ষ না করেই আবার চলে যাচ্ছিল সিঁড়ির দিকে।
পাতাবাহারের আড়াল থেকে মনুর সুন্দর চেহারাটা দেখে তৃণা। এই বয়সেই মনু মোটর চালায়, টেনিস খেলে, বিদেশি নাচ শেখে। তৃণার জগৎ থেকে অনেক দূরে ওর বসবাস। বড়সড় স্বাস্থ্যবান ওই ছেলেটা যে তার গর্ভজ সন্তান, তা তৃণার বিশ্বাস হয় না। বিশ্বাস হলেও এক এক সময়ে বড় ভয় করে, এক এক সময়ে অহংকার হয়। কিন্তু এ তো সত্যি কথা, মনুর জগতে তৃণা বলে কেউ নেই।
সিঁড়ির মাথায় চলে গিয়েছিল মনু। এক্ষুনি নেমে যাবে।
তৃণার গলায় একটুও জোর ফুটল না। ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকল–মনু!
ডাকটা মনুর শোনার কথা নয়। মস্ত হলঘরটার অন্য প্রান্তে চলে গেছে সে। তার ওপর শিসে একটা গরম হিন্দি টিউন তুলছে। তা ছাড়া যৌবনবয়সের চিন্তা আছে, আর আছে ঘরের বাইরে জগতের আনন্দময় ডাক। মায়ের ক্ষীণকণ্ঠ তার শোনার কথা নয়। তবু দ্রুত দু’ ধাপ সিঁড়ি চঞ্চল পায়ে নেমে গিয়েও দাঁড়াল সে! একটু এপাশ ওপাশ তাকাল। হয়তো ক্ষীণ সন্দেহ হয়ে থাকবে যে কেউ ডেকেছে।
পাতাবাহারের আড়ালে মুখখানা ঢেকে তৃণা তেমনি ক্ষীণ গলায় বলে, মনু, আমি এখানে।
এবার মনু শুনতে পায়। ফিরে তাকায়। মুখে একটু ভ্যাবলা অবাক ভাব। শরীরটা যত বড়ই হোক, ওর বয়সে এখনও ছেলেরা মায়ের আঁচলধরা থাকে।
মনু তাকে দূর থেকে দেখল। রাঙা শাড়ি পরেছে তৃণা, মেখেছে দামি বিদেশি সুগন্ধ, আর নানা রূপটান। নষ্ট মেয়ের সাজ। একটু আগে বাড়িতে ঢোকার সময়ে তাই কি ঠাট্টা করে মনু বলেছিলচ্যানেল নাম্বার সিক্স, না? নষ্টামিটা কি তৃণার শরীরে খুব স্পষ্ট হয়ে আছে?
মনু সিঁড়ির দু’ ধাপ উঠে আসে। হলঘরটা লম্বা পদক্ষেপে পার হয়ে সামনে দাঁড়ায়। মুখে একটা গা-জ্বালানো ঠাট্টার হাসি। হালকা গলায় বলে, আরে! তুমি তো বেরিয়ে গেলে দেখলাম।
তৃণা তৃষিত মুখখানা তুলে ওকে দেখে। কী বিরাট, কী প্রকাণ্ড সব মানুষ এরা।
মাথা নেড়ে তৃণা বলে, যাইনি।
যাওনি তো দেখতেই পাচ্ছি। কী ব্যাপার?
তুই কোথায় যাচ্ছিস?
বেরোচ্ছি।
আমার শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে।
শুনে মনুর মুখে খুব সামান্য, হালকা জলের মতো একটু উদ্বেগ খেলা করে গেল কি? বলল, শরীর খারাপ তো শুয়ে থাকো।
মনুর মুখখানা অবিকল তৃণার মতো। মাতৃমুখী ছেলে। ওর চোখে একটা মেয়েলি নম্রতা আছে। এ সবই তৃণার চিহ্ন। মনুর মুখে চোখে তৃণার চিহ্ন ছড়ানো আছে। অনেকদিন বাদে একটু লক্ষ করে তৃণা খুব গভীর একটা খাস ফেলে।
মনু একটু ঝুঁকে তাকে দেখে নিয়ে বলে, খুব সেজেছ দেখছি। তবু তোমাকে খুব পেল দেখাচ্ছে। চোখও লাল। ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো।
আমাকে একটু ধরে ধরে নিয়ে যাবি?
এসো। বলে সঙ্গে সঙ্গে মনু হাত বাড়ায়।
ভারী অবাক মানে তৃণা, ও কি তাকে ছোঁবে? ঘেন্না করবে না ওর? তৃণা সঙ্কুচিত হয়ে বলে, তোর দেরি হচ্ছে না তো!
হচ্ছে তো কী? এসো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাই ঘরে।
তৃণা উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ তাকে চমকে স্তম্ভিত করে দিয়ে মনু তাকে এক ঝটকায়। পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে চেঁচিয়ে হেসে বলে, আরে! তুমি তো ভীষণ হালকা।
তৃণার মাথা ঘুরে যায়, দম বন্ধ হয়ে আসে। সে ককিয়ে কান্না গলায় বলে, ছেড়ে দে, ওরে!
তুমি কি ভাবছ তোমাকে নিতে পারব না?
ফেলে দিবি। ক্ষীণ কণ্ঠে বলে তৃণা।
দূর! আমি ওয়েটলিফটার, জানো না? তুমি তো মশার মতো হালকা। বলে দুহাতে তৃণার শরীরটার। ওপরে নীচে একবার দুলিয়ে দেখায় মনু। তৃণা তখন ছেলের শরীরের সুঘ্রাণটি পায়। মৃদু সাবান পাউডার, আর জামাকাপড়ে ওয়ার্ডরোবের পোকা-তাড়ানো ওষুধের গন্ধ। এ সব ভেদ করে মনুর গায়ের রক্তমাংসের একটা গন্ধ, একটা স্পন্দন পায় না কি সে?
অনায়াসে মনু হলঘরটা পার হয়ে যায় তৃণাকে পাঁজাকোলে নিয়ে। তৃণা ভয়ে ভয়ে চোখ বুজে ছিল, মুঠো হাতে খামচে ধরে ছিল মনুর গেঞ্জির বুকের কাছটা।