তৃণা খাস ছেড়ে আপন মনে ভ্রূ কুঁচকে মাথা নাড়ে। এ সত্য তার জানা। প্রয়োজন হলে শচীন রেবাকে বাজারসুদ্ধ শাড়ি কিনে এনে দেবে। রেবা নিজে গিয়েও কিনে আনতে পারে বাজার ঘুরে, পছন্দমতো। তবু বাঙালি ঘরের রেওয়াজ, বয়স হলে মেয়েরা মায়ের শাড়ি পরে। সেটা শাড়ির অভাবের জন্য নয়। নিজের শাড়ি পরিয়ে মা মেয়েকে দেখে। মুখ টিপে মনে মনে হাসে। মায়েরা ওই ভাবেই আবার জন্মায় মেয়ের মধ্যে। কিন্তু রেবার তা দরকার নেই।
মুখশোষ টের পায় তৃণা। হাতে পায়ে শীত, মাথা গরম, খাস গরম। দু-পা হেঁটে যায় দরজার দিকে। একটু দাঁড়ায়। ফিরে তাকায় একবার। তার জ কোঁচকানো, চোখে বিশুষ্ক কামা। ওই গুয়ের গ্যাংলা মেয়েটা কত সহজে তার মা-পনা ঘুচিয়ে দেয়।
এ বাড়িতে দুটো ভাগ আছে। একদিকে তৃণা একা, অন্যদিকে শচীন, মনু আর রেবা। সিন্ডিকেট। ঘরগুলোর মাঝখানে যোজন-যোজন ব্যবধান পড়ে থাকে সারাদিন। তার পক্ষে কেউ নয়। তবু ওর মধ্যে কি মনু একটু মায়ের টান টের পায়? অনেকদিন ভেবেছে তৃণা। ঠিক বুঝতে পারে না। ন’ মাসে ছ’মাসে এক-আধবার মা বলে ডেকে ফেলে মনু। হয়তো কোনও কথা বলে ফেলে। খেতে বসে হয়তো এটা-ওটা চায়। তড়িঘড়ি এগিয়ে দেয় তৃণা। মনু কখনও কিছু বললে বাধ্য মেয়ের মতো তাই করে, তাই দেয়। কিন্তু বুকে এত কাঙালপনা নিয়েও তৃণা জানে, মনুর আসলে টান নেই। ও সোজা সরল ছেলে, দিনরাত খেলার কথা ভাবে, মাকে নিরন্তর ঘৃণা করার কথা মনে রাখতে পারে না। অন্যমনস্কতাবশত ভুলে যায়। একটু আগে কেমন স্মিতমুখে বলেছিল–চ্যানেল সিক্স না?
রেবার ভুল হয় না। নিরন্তর বুকে সাপের মতো পুষে রাখে উপেক্ষা আর ঘেন্না। কখনও তা থেকে অন্যমনস্ক হয় না রেবা। বয়স মোটে বারো বছর, এখনও ঋতুমতী নয় বোধ হয়, তবু কেমন সব গোপন করে রেখেছে মায়ের কাছে। কেমন স্বাধীন, ডাকাবুকো।
তৃণা যাই-যাই করেও খানিক দাঁড়ায়, বলে, আমার লকারে গাদা গয়না পড়ে আছে। পাঠিয়ে দেবখন, পরিস।
কে চেয়েছে?
চাইতে হবে কেন? ও তো তোর পাওনা।
আমি গয়না পরি না! তার ওপর সোনার গয়না! মাগো! বলে ঠোঁট মুখের একটা উৎকট ভঙ্গি করে রেবা।
তৃণা হ্যাংলার মতো হাসে। বলে, তা অবিশ্যি ঠিক। সলিড সোনার গয়না তোদের বয়সিরা আজকাল কেউ পরে না। বরং ভেঙে নতুন করে গড়িয়ে নিস।
আমি পরব না। তুমি পরো।
তুই তো একরত্তি মেয়ে, ওই রোগা শরীরে আর কখানা গয়নাই বা ধরবে। আমার অনেক আছে। তোকে দিয়েও থাকবে–তোরই তো সব।
তোমার কিছুই আমার নয়। না পরলে বিলিয়ে দিয়ো।
কেন, পরবি না কেন?
ইচ্ছে। শাড়ি গয়নার কথা শুনলে আমার মাথা ধরে। তুমি এখন যাও।
ভুল অস্ত্র। কিন্তু এ ঠিক তৃণার দিক থেকে লোভ দেখানো নয়। কিছুক্ষণ রেবার ঘরে থাকার জন্য এ হচ্ছে এলোপাথাড়ি কথা কওয়া,নইলে সে জানে, রেবার কিছু অভাব নেই। এখনকার মেয়েরা শাড়ি গয়নার নামে ঢলে পড়ে না।
রেবা খাটের অন্যধারে বসে পা দোলায়। পায়ের আঙুলের রুপোর চুটকিতে ঝুনঝুন শব্দ হয় একটু। খুব অবহেলার অনায়াস ভঙ্গি। তৃণার বারো বছর বয়সটা কেটেছে বিছানায়। ওই সময়ে এত সতেজ, প্রাপ্তবয়স্কতার ভাবভঙ্গি তার ছিল না। ওই বয়সে ছিল কত ভয়, সংশয়, কত আত্ম-অবিশ্বাস! তবু তৃণা। মনে মনে একরকম খুশিই হয়। মেয়েটা তার মতো হবে বোধ হচ্ছে। ছবি আঁকে, কবিতা পড়ে, শাড়ি-গয়নার দিকে মন নেই।
ও ঘরের বাথরুম থেকে মনুর সুরহীন হিন্দি গান শোনা যায়। তার সঙ্গে জলের প্রবল শব্দ। সেই জলশব্দে তেষ্টা পায় তৃণার। আসলে বুকটা কাঠ হয়েই ছিল। জলের কথা খেয়াল হচ্ছিল না তার।
ভিখিরির মতো তৃণা বলে, একটু জল খাওয়াবি রেবু?
রেবা ভীষণ বিরক্ত হয়। তার রোগা, তিরতিরে বুদ্ধির মুখখানায় কোনও মুখোশ নেই। সহজেই রাগ, বিরক্তি, অভিমান বোঝা যায়। জ্ব, নাক, চোখ কুঁচকে উঠল। তবু পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে দেয়ালে পিয়ানো রিডের মতো একটা সুইচ টিপে ধরল।
ঠিন ঠিন করে গোটা-দুই সুরেলা আওয়াজ হল ভিতরে। অমনি ঝি দুর্গার মা এসে দাঁড়ায় দরজায়, নীরবে।
রেবা বলে, এক গ্লাস জল।
এরকমই হওয়ার কথা। রেবা নিজের হাতে জল গড়িয়ে দেবে না, এ কি জানত না তৃণা?
দুর্গার মা হলঘরের কুলার থেকে ঠাণ্ডা জল এনে দিল। ট্রের ওপর স্বচ্ছ কাটগ্নাসের পাত্র, ওপরে একটা কাচের ঢাকনা। জলটা হিরের মতো জ্বলছে। তৃণা সবটুকু খেয়ে নিল।
রেবা বলে, এবার হয়েছে? এখন যাও। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
তৃণা ভাল মেয়ের মতো বলে, এই খাড়া দুপুরে আবার বেরোবি নাকি?
বেরোলেই বা!
কোথায় যাবি?
কাজ আছে।
তুই যে কবিতার বইগুলো কিনেছিস ওগুলোর সব আমার নেই। এক আধখানা দিস তো, পড়ব।
রেবা উত্তর দিল না। ওয়ার্ডরোব থেকে পছন্দমতো পোশাক বের করতে লাগল। একটা লুঙ্গি আর কামিজ বের করে সাজাল বিছানার ওপর। বিশুদ্ধ সিল্কের হালকা জামরঙের লুঙ্গি। সোনালি সিল্কের ওপর ছুঁচের কাজ করা কামিজ।
বাঃ ভারী সুন্দর তো।
কী সুন্দর! ঝামরে ওঠে রেবা।
পোশাকটা। কবে করালি?
রেবা তার পাতলা ধারালো মুখখানা তুলে তৃণাকে এক পলকের কিছু বেশি লক্ষ করল। তৃণা চোখ সরিয়ে নেয়।
রেবা বলে, তুমি যেখানে যাচ্ছ যাও।
তৃণা হ্যাংলার মতো তবু বলে, বড্ড রোদ উঠেছে আজ। ছাতা নিবি না?