ঘরে ধূপকাঠির গন্ধ, স্নো ক্রিম ফাউন্ডেসনের গন্ধ, ঘর-সুগন্ধির মৃদু সুবাস। দেওয়ালের রং হালকা। নীল, আর ধূসর। বিপরীত দেওয়ালগুলি একরঙা। নানারকম আলোর ফিটিংস লাগানো, জানালা দরজায় পর্দা, পেলমেটে কেষ্টনগরের পুতুল সারি সারি সাজানো। বুককেসের ওপর একটা রেডিয়ো টেপরেকর্ডার, একধারে মিউজিক সিস্টেম আর সিডি এবং ক্যাসেটের ক্যাবিনেট। সমস্ত বাড়িটাই দেবাশিস সাজিয়েছিল। আসবাবপত্রগুলি সবই সাপ্লাই দিয়েছিল তার কোম্পানি।
ফটোস্ট্যান্ডে রেবার ছবিটার দিকে ভীত চোখে চেয়ে ছিল তৃণা। তার মনে হচ্ছিল, সে রেবার মুখোমুখি বসে আছে। রেবা তাকে দেখছে। ফটোতে রেবার সুন্দর হাসিটা যেন আস্তে আস্তে পাল্টে শ্লেষ আর ঘৃণার হাসি হয়ে যাচ্ছে।
তৃণার বুক কেঁপে কান্নার গন্ধ মেখে একটা খাস বেরিয়ে আসে। দুবে বৃষ্টি হলে যেমন জলের গন্ধ আসে বাতাসে তেমনই কান্নাটা ঘনিয়ে উঠছে। গন্ধ পায় তৃণা। কিন্তু বৃথা। কত তো কেঁদেছে তৃণা, কেউ পাত্তা দেয়নি।
তৃণা বহুকাল বাড়ির এদিকে আসেনি। রেবার ঘরে ঢোকেনি। এখন একা চোরের মতো ঢুকে তার বড় ভাল লাগছিল। বারো বছর বয়সে মেয়েরা মায়ের বন্ধু হয়ে ওঠে। এই বয়ঃসন্ধির সময়ে কত গোপন মেয়েলি তথোর লেনদেন হয় মা আর মেয়ের মধ্যে, এই বয়সেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় পাকা। মেয়ে আর। মেয়ে থাকে না, সখী হয়ে ওঠে।
কিন্তু হায়, রেবার সঙ্গে তৃণার কোনওদিনই আর সখিত্ব হবে না। ভিতু তৃণাকে মানসিক ভারসাম্যের শেষ সীমা পর্যন্ত ঠেলে দেবে রেবা—বুদ্ধিমতী এবং নিষ্ঠুব ওই মেয়েটা।
তৃণা উঠল, রেবা গানের স্কুলে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে, কিন্তু নিঃশব্দে ফিরবে না। ওর ছটফটে দৌড়পায়ের আওয়াজ অনেক দূর থেকেই পাওয়া যায়। তাই সাহস করে তৃণা উঠে ঘুরে ঘুরে ওর ঘরটা দেখে। বুককে খুলে বই হাতড়ায়। ওয়ার্ডদেবের ভিতরে ওর হরেক ফ্রক, ঘাগরা, প্যারালেলস আর শাডিতে হাত বুলিয়ে নেয়। বিছানার ওপর একটা নাইটি পড়ে আছে। ভীষণ পাতলা একটা বিদেশি কাপড়ের তৈরি। সেটা গুছিয়ে ভাঁজ করে রেখে দেয়। বেডকভারটা টান করে একটু। পড়ার টেবিলটা সাজানো আছে। তবু একটু নেড়েচেড়ে রেখে দেয়, খুঁজতে খুঁজতে কয়েকটা ড্রইং খাতা পায় তৃণা, তাতে জলরঙা সব ছবি আঁকা। বুকের ভিতরটা ধুপধুপ করে ওঠে। রেবা কি ছবি আঁকে!
বুককেসের মাথায় রঙের বাক্স আর তুলির আলি খুঁজে পায় তৃণা। হ্যাঁ, সন্দেহ নেই, রেবা ছবি আঁকে। দরজার পাশে একটা নিচু শেলফে তবলা ড়ুগি, হারমোনিয়ম, তানপুরা সব সাজানো। হারমোনিয়ামের বাক্সের ওপর একটা কবিতার বইও পেয়ে যায় সে। বুক একটা আনন্দ সদ্যোজাত পাখির ছানার মতো শব্দ করে। রেবা কি কবিতা পড়ে।
আবার গিয়ে বুককেসটা খোলে তৃণা। বইগুলো ঠিকমতো সাজিয়ে রাখা নেই। তাই অসুবিধে হয়। তবু একটু খুঁজতেই তার মধ্যে কিছু কবিতার বই খুঁজে পায় তৃণা। অবাক হয়ে উল্টেপাল্টে বইগুলো দেখে সময়ের জ্ঞান হারিয়ে যায়।
অন্যমনস্কতাবশত সে পায়ের শব্দটা শুনতে পায়নি, যখন শুনল তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। পর্দা সরিয়ে রেবা ঘরে ঢুকেই দাঁড়িয়ে পড়ল। রোগা তীক্ষ্ণ মুখখানা হঠাৎ সন্দিগ্ধ আর কুটিল হয়ে উঠল। ভ্রূ কোঁচকানো, রেবা তার দিকে একপলক চাইল তারপর চোখ ফিরিয়ে পা নেড়ে চটিদুটো ঘরের কোণে ছুড়ে দিল। ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরে গিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে। একপলকে সে তাকিয়েছিল তৃণার দিকে তাতে চোখে একটু বুঝি বিস্ময়, আর একটু ঘৃণা। বাদবাকি ব্যবহারটা উপেক্ষার।
পরনে একটা কমলারঙের হালফ্যাশনের ফ্রক। রোগ হলেও রেবা বেশ লম্বা। গায়ে মাংস লাগলে একদিন ফিগারটা ভালই দেখাবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের একটা ব্রণ টিপল। আঙুল দিয়ে ঘষল জায়গাটা।
বলল, কী বলতে এসেছ?
একটু চমকে উঠল তৃণা। এঘরে সে যে অনধিকারী তা মনে পড়ল। বিপদ যা ঘটবার তা ঘটে গেছে, সে তো আর পালাতে পারে না এখন। আস্তে করে বলল, তোর আজ তাড়াতাড়ি হয়ে গেল যে।
অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে রেবা উত্তর দেয়— এ সময়েই ছুটি হয়। তাড়াতাড়ি আবার কী?
বলে আয়নায় মুখ দেখতে থাকে। আয়নার ভিতর দিয়েই বোধ হয় তৃণাকে এক-আধ পলক দেখে নিল। কিন্তু তৃণার সেদিকে তাকাতে সাহসই হল না। অপরাধীর মতো মুখ নিচু রেখে বলে, তুই কি ছবি
আঁকিস রেবু?
রেবা একটু অবাক হয় বোধ হয়। বলে, হ্যাঁ আঁকি।
জানতাম না তো!
ক্লাসে আমাদের ড্রইং শেখায়। এ সবাই জানে।
কবিতা পড়িস?
পড়ি।
তৃণা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
রেবা একটু ঝাঁজ দিয়ে বলে, আর কী বলবে?
কিছু না।
আমার এখন অনেক কাজ আছে। পোশাক ছাড়ব। তুমি যাও।
যাচ্ছি। তৃণা উঠে দাঁড়ায়। কোনও বয়সের মেয়েই মায়ের সামনে পোশাক ছাড়তে লজ্জা পায় না। তবু তৃণা সসঙ্কোচে উঠে দাঁড়াল। এই ঘরে তার উপস্থিতির কোনও জরুরি অজুহাত খুঁজে না পেয়ে দুর্বল গলায় বলে, তুই নতুন কী রেকর্ড কিনলি দেখতে এসেছিলাম।
রেবা উত্তর দিল না। আয়নায় মুখ দেখতে থাকল।
তৃণা একটু শুকনো গলায় বলে, তোর ওয়ার্ডরোবে শাড়ি দেখছিলাম। পরিস না কি?
ইচ্ছে হলে পরি। তুমি যাও।
যাচ্ছি। আমার তো অনেক শাড়ি। তুই নিবি?
না।
কেন?
আমার অনেক আছে। দরকার হলে বাপি আরও কিনে দেবে।