একদিন মনের ভুলে ফুলি একটা জয়পুরি ছাপওলা সিল্কের শাড়ি পড়েছিল রবির সামনে। রবি হাঁ করে কিছুক্ষণ দেখল শাড়িটা, তারপর মুখখানায় হাসি কান্না মেশানো একরকম অদ্ভুতভাব করে বলল, মণিমা, আমার মায়ের ঠিক এমন একটা শাড়ি ছিল।
শিশুদের মনের খবর রাখা খুবই শক্ত। ওদের স্মৃতি কত দূরগামী, কত ছবির মতো স্পষ্ট ও নিখুঁত তা বুঝতে পেরে একরকম অদ্ভুত যন্ত্রণা পেয়েছিল দেবাশিস। পারতপক্ষে সে তার মায়ের কথা বলে না। জানে, সে মায়ের কথা বললে তার বাবা খুশি হয় না। এতটা বুদ্ধি ওই শিশু-মাথায়।
বুকের ভিতরটা চলকে ওঠে দেবাশিসের। ছেলেটার প্রতি হঠাৎ ভালবাসায় ছটফট করে। পার্কস্ট্রিটের একটা বড় রেস্টুরেন্টে বসে মেনুটা রবির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, তোমার যা ইচ্ছে অর্ডার দাও। যা খুশি।
বলে ছেলের দিকে চেয়ে থাকে।
রবি অবাক হয়ে বাবার দিকে চায়। মিটমিটে চোখে বাবার মুখখানা দেখে বলে, আমার তো ক্ষিদে নেই।
দেবাশিস হতাশ হয়ে বলে, সে কী!
রবি মাথা নেড়ে বলে, দিদি সকালে কত খাইয়েছে! বলতে বলতে গেঞ্জিটা ওপর দিকে তুলে পেটটা দেখিয়ে বলে, পেট দ্যাখো কেমন ভর্তি।
দিনের মধ্যে একশোবার রবির গায়ে হাত দিয়ে দেখত চন্দনা, টেম্পারেচার আছে কি না! রবির গায়ে হাত দিয়ে আবার নিজের গা দেখত, কখনও বা দেবাশিসকে ডেকে বলত দেখি তোমার গা রবির চেয়ে ঠাণ্ডা না গরম।
সব মায়েরই এই বাতিক থাকে। তার নিজের মায়েরও ছিল। আরও, দিনে একশোবার রবিকে খাওয়ানোর জন্য মাথা কুটত চন্দনা, খাইয়ে পেট দেখত। খেতে না চাইলে অনুনয় বিনয়, খোশামোদ, তারপর কিলচড় কষাত। বলত— না খেয়ে একদিন শেষ হয়ে যাবি। আমি মরলে কেউ তোর খাবার নিয়ে ভাববে ভেবেছিস?
খাওয়ার ব্যাপারটা হলেই ছোট্ট রবি মাকে পেট দেখাত।
গেঞ্জিটা নামিয়ে করুণ চোখে রবি বলে, খাব না বাবা।
দেবাশিস একটা শ্বাস ফেলে বলে, আচ্ছা।
বাবা।
উঁ।
মণিমা তো মুরগি খায় না।
দেবাশিস খেয়াল করল। বলল, তাই তো! কিন্তু অর্ডার দিয়ে দিলাম যে।
মণিমার জন্য কী নেবে?
তুমিই বলো।
সন্দেশ আর দই, হ্যাঁ বাবা?
আচ্ছা।
রবি খুশি হয়ে হাসল। দেবাশিস রবির কথা শোনে। রবি যা চায় তাই দেয়। রবির যা ইচ্ছা তাই হয়। চন্দনার সময়ে তা হত না। রবি কিছু বায়না করলেই ক্ষেপে যেত চন্দনা। বকত। মারত। তবু সারাদিন চন্দনার পায়ে পায়ে ঘুরত রবি। বকা খেত, মার সহ্য করত, তবু আঁটালির মতো লেগে থাকত।
ওই রাগি আহাম্মক মেয়েটার মধ্যে আকর্ষণীয় বস্তু কী ছিল? ভেবেই পায় না দেবাশিস। যে অবস্থায় চন্দনার বিয়ে হয়েছিল তাতে তার বাপের বাড়ির দিকের কেউ খুশি হয়নি। চন্দনার বাবা তাকে প্রচুর মারধর করে বেঁধে রেখেছিলেন, মা কাঁদতে কাঁদতে হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হন। সেই গোলমাল হাঙ্গামার ভিতর থেকে চন্দনাকে খুব শালীনতার সঙ্গে বিয়ে করে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। দেবাশিস কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে একদিন ওদের বাড়ি চড়াও হয়। পাড়ার ছেলেদের আগে থাকতেই মোটা পুজোর চাঁদা দেওয়া ছিল। দেবাশিস চন্দনার বাবাকে শাসিয়ে এল ফের ওর গায়ে হাত তুলবেন তো মুশকিল। আছে।
চন্দনার বাবা ভয় পেয়ে গেলেন। আজকাল ভদ্রলোক মানেই ভেড়ুয়া। এরপর থেকে চন্দনার ওপর অত্যাচার কমে গেল বটে, কিন্তু বাড়ির লোক তার সঙ্গে কথা বলত না। দেবাশিস তখন মানিকতলায় বোনের বাড়িতে আলাদা একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। একজন গর্ভবতী মেয়েকে বিয়ে করে তোলা ভগ্নীপতি ভাল চোখে দেখেনি। বোনও রাজি ছিল না। চন্দনা প্রায়ই টেলিফোন করে বলত— বেশি কিছু তো চাইনি, কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে সিথিতে একটু সিঁদুর ছুঁইয়ে দাও। তা হলেই হবে।
দেবাশিস বলত–তা হবে না। সেটা তো পরাজয় মেনে নেওয়া। আমি তোমাকে ফুল ফ্লেজেড বিয়ে করে নিজের বাসায় তুলব।
তাই করছিল সে। পাগলের মতো ঘুরে যাদবপুরে বাসা ঠিক করে ফেলল। হাতে টাকার অভাব ছিল না। প্রচুর গয়না শাড়ি দিয়ে সাজিয়ে বিয়েবাড়ি ভাড়া করে পুরুত ডেকে বিয়ে করল। চন্দনার এক দাদা সম্প্রদান করে যান।
চন্দনার মতো একটা অপদার্থ মেয়ের জন্য এত পরিশ্রম আর হাঙ্গামা কেন করেছিল দেবাশিস, তা ভাবতে অবাক লাগে। বিয়ের অল্প কিছু পরেই চন্দনার তাগাদায় অভিজাত পাড়ায় অনেক টাকা দিয়ে পূর্ব-দক্ষিণ খোলা ফ্ল্যাট কিনল। এই বিপুল উদ্যোগ বৃথা গেছে। বিয়ের অল্প কিছু পরেই দেবাশিস বুঝতে পারে, বিয়ে কোনও স্বর্গীয় বিধি নয়। চন্দনা তার বউ হওয়ার উপযুক্ত নয়। এত অগভীর মন, এত রাগ, অধৈর্য, এমন অর্থকেন্দ্রিক মন-সম্পন্ন মেয়ের সঙ্গে কী করে থাকবে সে। নিজে চরিত্রহীন হলেও তার কিছু শিল্পীসুলভ নিস্পৃহতা আছে, সামান্য কিছু ব্যবসায়িক সততা, কর্মনিষ্ঠা। তার মনে হত সারাদিন কাজের পর পুরুষ যখন বাসায় ফেরে তখন দগ্ধ দিনে ছায়ার মতো স্ত্রী তাকে আশ্রয় দেয়। স্ত্রী। হচ্ছে বিশ্রামের জায়গা।
দেবাশিস প্রায়দিনই বাসায় ফিরে চন্দনাকে দেখতে পেত না। হয় মার্কেটিং, নয় সিনেমা-থিয়েটার, নয়তো বাপের বাড়ি চলে যেত চন্দনা। বিয়ের পর বাপের বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক কীভাবে যেন নিদারুণ ভাল হয়ে গিয়েছিল। ওই সময়ে নিঃসঙ্গ তৃণা এক নিভৃত জলস্রোতে নৌকোর মতো তার কাছাকাছি এসে গেল। উতরোল স্রোত। কিন্তু নিশ্চিত। দেবাশিস কোনওদিনই কারও প্রেমে পড়েনি এতকাল। এবার পড়ল। এক অসহনীয় অবস্থায়। অসম্ভব এক প্রেম।