নীচের থাক নাড়া দিতেই হাসি দেখতে পায় ইঁদুরের কাটার চিহ্ন। তার শায়া, ব্লাউজ, ব্রেসিয়ারের এখানে-সেখানে ফুটো। গরম জামার থাক ভরতি জামাকাপড় কেটে রেখেছে। কত কি কেটেছে দেখার জন্য হাসি সব জামাকাপড় নামিয়ে মেঝেতে স্তূপ করে। একটা পুরোনো ফুলহাতা সোয়েটারে জড়ানো দু-বাণ্ডিল চিঠি। চিঠির বাণ্ডিল তুলতেই ঝুরঝুর করে কাগজের টুকরো ঝরে পড়ে। অমিয় দু-দফায় দিল্লি আর কানপুর গিয়েছিল। প্রথমবার দু-মাস, দ্বিতীয়বার মাসখানেকের জন্য। আর দুবার বাপের বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন করে ছিল হাসি। সেইসব সময়ে অমিয় লিখেছিল এইসব চিঠি। ইঁদুর নষ্ট করে গেছে। সবচেয়ে ওপরের চিঠিটা খুলে কয়েক পলক দেখে হাসি। ছিদ্রময় প্রেমপত্র। প্রিয়তমাসু… হাসি পড়তে থাকে
-তোমার জন্য ভীষণ (ফুটো) হয়ে আছি। কবে আসছ? তোমার জন্য এমন (ফুটো) লাগছে যে কি বলব। আমার (ফুটো) ভিতরটা তো তুমি (ফুটো) পাও না… রানি আমার, আমার (ফুটো), কবে (ফুটো)? তোমার জন্য আমি সব (ফুটো) পারি। তাড়াতাড়ি চলে (ফুটো)…
হাসি একটু হাসে। চিঠি দেখে নয়। প্রেমপত্র লিখতে অমিয় জানে না। দু-চারটে দুর্দান্ত এলোমেলো আবেগের লাইন লিখেই তার সব কথা ফুরিয়ে যায়। কোনো ইনল্যাণ্ডের একটার বেশি ফ্ল্যাপ (ফুটো) ভরতি করতে পারেনি সে।
ছিদ্রময় এই চিঠিগুলো নিয়ে কী করবে তা ঠিক করতে পারে না সে। নিয়ে যাবে? নাকি পুড়িয়ে ফেলবে? ভাবতে ভাবতেই আবার পুরোনো পুলওভারে চিঠিগুলো জড়িয়ে ওয়ার্ডরোবে আগের জায়গায় রেখে দেয়। থাকগে। থাকতে থাকতে একদিন পুরোনো হয়ে হয়ে ধুলো হয়ে যাবে আপনা থেকে।
মধুকে ডেকে হাসি ন্যাপথলিন আনতে বলে, আর ইঁদুর মারা বিষ। তারপর একে একে ট্রাঙ্ক, বাক্স, স্টিলের আলমারি–সবই খুলে ফেলে সে। জামাকাপড় নামায়, ছিদ্র খুঁজে দেখে। সব জায়গাতেই হয়েছে ইঁদুরের দাঁতের দাগ। ভিতরে ভিতরে সব ফোঁপরা করে দিয়ে গেছে। আবার সব গোছ করে তুলতে বেলা গড়িয়ে যায়। সঙ্গে নেওয়ার জন্য সাদামাটা কয়েকটা জামাকাপড় আলাদা করে রাখে হাসি। দু একটা প্রসাধন। কিছু টাকা। কবে যাওয়া হবে তার কিছু ঠিক নেই। দার্জিলিং মেলে এখন সামার-রাশ। জামাইবাবুকে রিজার্ভেশন করতে বলা আছে।
ঘর-দোর আবার ঝাঁট দেয় হাসি, আটার গুলিতে বিষ মিশিয়ে রাখে ওয়ার্ডরোবে, খাটের তলায়, রান্নাঘরে। স্নান করে খেয়ে উঠতে বেলা দুটো বাজে।
মেঝেয় শতরঞ্জি পেতে একটু গড়িয়ে নেয় হাসি। মেঝে থেকে শীতভাব উঠে আসে শরীরে। বাইরে রোদের মুখে ছায়া পড়েছে। মেঘ করল নাকি! বুকের ওপর সিলিং ফ্যানটার ঝকঝকে ইস্পাতের রঙের ব্লেডগুলো একটা প্রকান্ড স্থির বৃত্ত তৈরি করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের মতো। বাতাস নেমে এসে মেঝেতে চেপে ধরে হাসিকে! মধু রান্নাঘর ধোলাই করছে। কলঘরে জলের শব্দ। দূরে মেঘ ডাকছে। জানালা-দরজায় সব পর্দা ফেলা। ঘরে একটা সবুজ আভা। হাসি একটু চেয়ে থাকে, কিন্তু কিছুই দেখে না। দেখার জন্য সে চেয়েও নেই। দুই ঘরের এই যে ছোট্ট বাসা, এই কি সংসার? খাট, আলমারি, খাওয়ার টেবিল, ড্রেসিং টেবিলের আয়না–দৃশ্যমান যা কিছু আছে, যা ধরা-ছোঁয়া যায় তার কোনোটাই কি একটা মানুষের সঙ্গে আর একটা মানুষকে আটকে রাখতে পারে? ঘরে দরজা দিয়ে দাও, শরীরে শরীর মিশিয়ে ফেলো, সারাবেলা বললো ভালোবাসার কথা, পোষা পাখীর মতো, ওয়ার্ডরোবে জমে উঠুক প্রেমপত্র–তবু কিছুই প্রমাণ হয় না। সরকারি দপ্তরে হাসি আর অমিয়র বিয়ের দলিল নব্বই কী এক-শো বছর ধরে জমা থাকবে–অতদিন ধরে তাতে লেখা থাকবে যে তারা আইনগত ভাবে স্বামী-স্ত্রী। তবু কিছু প্রমাণ হয় না। হাসি পাশ ফিরে শোয়।
খামের ওপর সাঁটা একটা ডাকটিকিট জলে ভিজিয়ে খুব সাবধানে তুলে নিচ্ছে হাসি। খামের ওপর টিকিটের চৌকো চিহ্ন একটা থেকে যাবে-থাকগে। নাকি কোনোদিনই টিকিটটা ঠিকমতো সাঁটা ছিল না খামের গায়ে? দুটো শরীর কেবল পরস্পরকে ডাকাডাকি করেছে এতকাল? মন নয়, বিশ্বাস নয়, নির্ভরতা নয়।
ছেলেবেলা থেকেই তার মন বলত-কলকাতা কলকাতা!
গরিব ঘরেই জন্ম হয়েছে হাসির। তার বাবা কাছাড়ের এক ছোট্ট চা-বাগানের কেরানি। তারা ছয় ভাই-বোন। হাসি চতুর্থ। লেখাপড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। শিলচরে থাকত এক মাসি, তার ছেলেমেয়ে নেই। সেই মাসিই নিয়ে গেল হাসিকে, পালত পুষত। শিলচর কলেজ থেকেই সে বি-এ পাশ করে, শিলচরেই শেখে মণিপুরি নাচ। লেখা পড়া, নাচ, গানবাজনা– এ সবই হাসি শিখত প্রাণ দিয়ে। এই সব লোকে শেখে কত কারণে। হাসির কারণ ছিল ভিন্ন। হাস্যকর সে কারণ, তবু কত সত্য।
ছেলেবেলা থেকেই তার মন বলত-কলকাতা, কলকাতা! চা বাগানে তার ছেলেবেলা কেটেছে। চারদিকে ঘন গাছের বেড়া জাল, বৃষ্টি পড়ত খুব, আবার রোদ উঠলে চা-পাতার মাতলা গন্ধে ম-ম করত বাতাস। রাতে ফেউ ডাকত, শেয়াল কাঁদত, তাদের বাড়ির আনাচে কানাচে এঁটোকাঁটা খেতে আসত শুয়োরের মতো মুখওয়ালা বাগডাশা। ঝিঁঝির ডাক রাতে অরণ্যকে গভীর করে তুলত। শীতকালে পড়ত অসহ্য শীত, মাটির ভাপ কুয়াশার মতো হয়ে বর্ষাকালে চরাচর আড়াল করত। পাহাড়ি পথ হঠাৎ বাঁক ঘুরে রহস্যে হারিয়ে যেত। তারা ভাইবোনেরা উৎরাই ভেঙে দৌড়ে দৌড়ে খেলত ছোঁয়াছুঁয়ির খেলা। দীনদরিদ্র ছিল তাদের পোশাক, আসবাব। তাদের ছোট্ট বাড়িটিতে তাদের অতজনের ঠিক আটত না। সেই বাগানে তাঁর ছেলেবেলার প্রথম বাবার কাছে কলকাতার গল্প শোনে। বেশিরভাগই কলকাতার দৃশ্যের গল্প, গাড়িঘোড়া, আলো, দোকান আর লোকজনের গল্প। বাবা গল্প বলতেন সুন্দর, আস্তে আস্তে, সময় নিয়ে প্রতিটি দৃশ্য যেন নিজেও প্রত্যক্ষ করতেন। সেই সব গল্পে তাঁর যৌবনকালে কলকাতার ছাত্রজীবনের নানা দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকত। আর থাকত কলকাতা ছেড়ে আসবার বিরহ-যন্ত্রণা। হাসির মনে সেই প্রথম কলকাতার নাম বীজের মতো ঢুকে যায়। সে বাবাকে বলত–চলো না বাবা, কলকাতা যাই। বাবা স্থির থেকে বলত–দূর! আর যাওয়া হবে না। সেখানে আমাদের আত্মীয়স্বজন কেউ নেই, কোনো কাজও নেই সেখানে, খামোখা টাকা-পয়সা খরচ করে চারদিনের রাস্তার ধকল সয়ে কার কাছে যাব? হাসির মন বলত–কেন, কলকাতার কাছে।