-হুঁ।
–সেটার কী করব বলুন তো?
–আপনার কী ইচ্ছে?
–ইচ্ছে নেই।
–অমিয় চেয়ে থাকে।
রজত আবার বলে–চলেই যাচ্ছি যখন, তখন আবার এখানে একটা ফ্যাঁকড়া রেখে যাই কেন! মেয়েটা হয়তো অপেক্ষা করবে। করতে করতে বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাবে। এক ফাঁকে এসে অবশ্য বিয়ে করে নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু তার আর কী দরকার? ওখানেই যখন বরাবর থাকব তখন ওদিকেই বিয়ের সুবিধে। তাই মেয়েটাকে সব বুঝিয়ে কাটিয়ে দিয়ে যাব। ভালো হবে না?
অমিয় মাথা নেড়ে বলে–হবে।
রজতকে খুশি দেখায়। সে একবার শিস দেয়, দু-কলি গান গুনগুন করে গায়।
কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হচ্ছে। কেউ আসছে। টপ করে নিজের অজান্তেই উঠে পড়ে অমিয়।
–রজতবাবু, কেউ এলে কাটিয়ে দেবেন। আমি বোসের ঘরে ফোন করতে যাচ্ছি।
রজতের অভ্যাস আছে। অনেকদিন ধরেই অমিয়র সময় ভালো যাচ্ছে না। রজত মাথাটা হেলিয়ে একটু হাসল–ঠিক আছে ঠিক আছে। বাগচী, উই আর কমরেডস আফটার অল–
সিঁড়ি দিয়ে যে উঠছে সে যে-ই হোক অল্পের জন্য অমিয়কে ধরতে পারল না। অন্ধকার প্যাসেজটা প্রায় লাফিয়ে পার হয়ে এল অমিয়।
বোস বুড়ো মানুষ। দুই ভাই পাশাপাশি চেয়ারে বসে থাকে। এক সময়ে ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটার হিসেবে একটু নাম ছিল। এখন কিছু নেই। অফিস আছে। এই পুরো তিনতলাটা তাদের লিজ নেওয়া। লিজ নিয়ে কল্যাণের তৃষ্ণা এবং আরও কয়েকজনকে অফিস ভাড়া দিয়েছে। ওইটাই আয় এখন। জটাওয়ালা একজন তান্ত্রিক এসে প্রায়ই দুই ভাইয়ের মুখোমুখি বসে থাকে। আজও আছে। ঠাণ্ডা অন্ধকার ঘরে তিনজন বয়স্ক নিস্তব্ধ মানুষ। কোনো কাজ নেই।
টেলিফোনটার সামনে একটু দাঁড়ায় অমিয়। কাকে ফোন করবে বুঝতে পারে না। কোনো নম্বর মনে আসে না। তবু হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে নেয়, ডায়াল টোন শোনে। কিড়-কিড় শব্দ হয়। কোনো নম্বর মনে আসে না। তবু অমিয় আঙুল বাড়ায়। দুইয়ের গর্তে আঙুল ঢুকিয়ে ডায়াল ঘোরায় তারপর তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত…। অপেক্ষা করে। টেলিফোন একটু নিস্তব্ধ থাকে। তারপর খুট করে একটা শব্দ হয়। পরমুহূর্তে হঠাৎ অমিয়কে চমকে দিয়ে ওপাশে একটা দীর্ঘ টানা মুমূর্ষু চীৎকার শোনা যায়–অমিয়–ও–ও, অমিয়–ও–ও, অমিয়-ও-ও
অমিয় কেঁপে ওঠে প্রথমে। কে? বলে চীৎকার করতে গিয়েও থেমে যায়। তারপর বুঝতে পারে, ওটা এনগেজড সাউণ্ড। ধীর কান্নার মতো বিষণ্ণ শব্দ। কতবার শুনেছে সে। আসলে মনটা ঠিক জায়গায় নেই। ফোনটা আবার রেখে দেয় অমিয়। দাঁড়িয়ে থাকে। একটু আগে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে কে উঠে এল তা ভাবতে চেষ্টা করে। অন্ধকার সিঁড়িতে আবছায়া নতমুখ একটা অবয়বকে এক ঝলক দেখেছিল। একটু সময় কাটানো দরকার।
আবার ডায়াল ঘোরায় অমিয়। সম্পূর্ণ আন্দাজে। কোন নম্বরে আঙুল তা তাকিয়ে দেখে না। খুব খিদে পেয়েছে অমিয়র। মুখটা তেতো তেতো। বোধ হয় পিত্তি পড়েছে। সকাল থেকে সে প্রায় কিছুই খায়নি। মাথাটা ঘোরে। শরীর দুর্বল লাগে। এরপর থেকে অফিসের নীচে, খোলা রাস্তায় আর স্কুটারটা রাখা যাবে না। নীচে স্কুটারটা দেখে সবাই বুঝতে পারে, অমিয় অফিসে আছে। আহমদকে বলবে একটা গোপন জায়গার বন্দোবস্ত করতে। ঘড়ির দোকানের পাশে একটা এঁদো গলি আছে–সেখানে রাখলে কেমন হয়?
ফোনটা কানে চেপে ধরে থাকে অমিয়। ডায়াল টোন থেমে গেছে। এইবার নম্বর আসবে। অমিয় অপেক্ষা করে। স্পষ্ট শুনতে পায় ওপাশে দু-একটা কলকব্জা নড়ছে, লিভার উঠছে। প্রথমে ভার্টিকাল তারপর হোরাইজন্টল খোঁজ শুরু করে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র! কিন্তু নম্বরটা খুঁজে পাচ্ছে না। খুঁজছে–প্রাণপণে খুঁজছে যন্ত্রটা। খুঁজে পাচ্ছে না। অমিয় অপেক্ষা করে। যন্ত্রের শব্দ থেমে যায়। নম্বরটা কী পাবে না অমিয়? সে অপেক্ষা করে।
যন্ত্রটা অস্ফুট শব্দ করে, তারপর প্লাগ দেয়। রিং করার শব্দ হয় না, এনগেজড থাকারও শব্দ হয় না। কিন্তু তবু কানেকশন ঠিকই পায় অমিয়। স্পষ্ট বুঝতে পারে, ওপাশে টেলিফোন হাতে নিয়েছে এক গভীর নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতায় খুব উঁচু থেকে বালিয়াড়ি নেমে গেছে বহুদূর। ধু-ধু বালিতে শব্দহীন জোৎস্না পড়ে আছে। হাড়ের মতন সাদা বালি-গড়ানে– তারপর অন্ধকার জেটি, ঘোলা জল। শেয়ালের চোখের মতো চকচক করে ওঠে জোনাকি পোকা। এ-পাড়ে দিনের আলো থেকে ও-পাড়ে গভীর রাতের মধ্যে চলে যায় টেলিফোন। সেখানে বাতাসের শব্দ নেই, জলের শব্দ নেই। বালির ওপরে একটা সাপের খোলস উলটে পড়ে আছে। বালিতে ঢেউয়ের দাগ। বহু দূর-দিগন্তব্যাপী সেই নিস্তব্ধতা টেলিফোন ধরে থাকে ওপাশে। অমিয় সেই নিস্তব্ধতাকে শোনে।
ক-দিন ধরেই ইঁদুরের খুটখাট সারা বাড়িময় শুনছে হাসি। কখনো ওয়ার্ডরোবে, কখনো খাটের তলায়, জুতোর র্যাকে, রান্নাঘরে। অবিরল দাঁতে কেটে দিচ্ছে সংসার। নিশুতি রাতে ঘুম ভেঙে মাঝে মাঝে শুনেছে এক ঘর থেকে আর এক ঘরে চি-চিক-চিক আনন্দিত চিৎকার ছুটে যাচ্ছে। কুড়-কুড়-কুড়-কুড় কাটার শব্দ হয়েছে। হাসি তেমন গা করেনি। কাটছে কাটুক।
২. অমিয় বেরিয়ে যাওয়ার পর
সকালে অমিয় বেরিয়ে যাওয়ার পরই হাসি গোছগাছ করতে বসেছে। থাকে থাকে শায়া, ব্লাউজ, ব্রেসিয়ার জমে গেছে। এতসব পরার সময় হয়নি। ট্রাঙ্ক ভর্তি রয়েছে শাড়ি, র্যাকে নানারকমের জুতো, ড্রেসিং টেবিলে সাজগোজের অসংখ্য টুকিটাকি। এসব কিছুই নেবে না সে। দু-চারটে মাত্র নেবে–যা নাহলে নয়।