-ওসব নয়। এ একটা অন্যরকম ফেরিঘাট। বহু দূর পর্যন্ত বালিয়াড়ি, তারপর ঘোলা জল –চোখ বুজলেই দেখতে পাই। ভীষণ ভয় করে, আবার ভীষণ ভালোও লাগে।
–আমি ঠিক জানি, তুই হাসির সঙ্গে ঝগড়া করেছিস। কিংবা ব্যবসাতে মার খেয়েছিস। কত টাকা রেখে গিয়েছিল মামা?
-হাজার দশেক।
–সেটাই ভুল হয়েছিল। কে যে তোর মাথায় ব্যবসা ঢুকিয়েছিল। বাঙালি ছেলে আবার কবে ব্যবসা করতে শিখেছে। তার চেয়ে একটা বাড়ি করে ভাড়াটে বসিয়ে গেলে
–স্টিমারঘাটটার কথা তুমি কিছু জান না, না?
–কী জানব? তোর মাথায় যতসব পাগলামির পোকা। হাসিকে নিয়ে কবে আসবি বল?
–তোমার কিছু মনে হয় না? স্টিমারঘাট বা ওরকম কিছু?
সোমাদি হাসে। বলে–আচ্ছা জ্বালাতন! ভাবনাচিন্তা করার সময় কোথায় আমার বল তো? সকাল সাড়ে আটটার লেডিজ স্পেশাল ধরতে বেরোই, মাইলখানেক হেঁটে বাস-রাস্তা, অফিসে সারাক্ষণ কাজ, ফিরতে ফিরতে আটটা হয়ে যায়। তখন শরীরে থাকে কী? খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, স্বপ্নও দেখি না।
অমিয় শ্বাস ফেলে। বলে–তুমি কাঠ হয়ে গেছ।
একটু ইতস্তত করে সোমাদি বলে–তোর দেশের পুকরঘাটের কথা মনে পড়ে। খুব বড়ো বড়ো কচুপাতা বাতাসে নড়ত। মাছ ফুট কাটত জলে। কদমগাছের ছায়ায় আমরা গঙ্গা-যমুনা খেলতাম। মনে হওয়ার কি শেষ আছে! কত কী মনে হয়। ওসব নিয়ে ভাবনার কী। হাসির সঙ্গে ভাব করে ফেল। ফেরার সময়ে একখানা শাড়ি আর দুটো সিনেমার টিকিট কিনে নিয়ে যা। কালকের দিনটা হোটেল-রেষ্টুরেন্টে খাস। এরকম একটু-আধটু করলেই দেখিস আর ঝগড়া হবে না।
-তুমি এসব কবে থেকে ভেবে রেখেছ সোমাদি! বিয়ে হলে বরের সঙ্গে কীরকম সব মান-অভিমান হবে, সব ভেবে রেখেছিলে। আর বলছ, ভাববার সময় পাও না!
–সোমাদি হেসে ওঠে। বলে–ঠিক বলেছিস।
একজন দু-জন করে মেশিনগুলোর সামনে মেয়েরা এসে বসছে। টিফিন শেষ।
অমিয় উঠে দাঁড়ায়।
–চলি।
সোমাদি গ্লাস পাওয়ারের চশমার ভেতর দিয়ে তাকায়। চোখে অন্যমনস্কতা। বলে সম্পর্কটা রাখিস অমিয়। মাকে গিয়ে দেখে আসিস। হার্ট ভালো না, কখন কী হয়ে যায়।
–যাব।
অফিসে এসে অমিয় দেখে, কেউ নেই। দুপুরের ডাকে ইন্সিয়োরেন্সের একটা চিঠি এসেছে। গতবছরের প্রিমিয়াম বাকি। বছর তিনেক আগে, বিয়ের পরই দশ হাজার টাকার একট পলিসি করিয়েছিল। দু-বছর প্রিমিয়াম টেনেছে। যাকগে, পেইড-আপ হয়ে যাবে।
গ্লাসের নীচে চাপা দিয়ে কল্যাণ একটি চিঠি রেখে গেছে–বাগচী, হায়দার তাগাদায় এসেছিল। ভুজং-ভাজুং দিয়ে বিদায় করেছি। ইনকাম-ট্যাক্সের অজিতকে একবার ফোন করবেন, ওকে আপনার কথা বলা আছে। ওর দাদা একটা লোন সোসাইটির মেম্বার, একটা লোন পাইয়ে দিতে পারে। আমি সিনেমায় যাচ্ছি, আজ ফিরব না। রাজেনের কাছে চার-শো টাকা রাখা আছে। কাল সকালেই গিয়ে মিশ্রিলালকে দিয়ে আসবেন। ফুড-সাপ্লাইটা ছাড়বেন না,..
চোখটা একটু ঝাপসা লাগে। চিঠিটা রেখে দেয় অমিয়। অফিস ঘরটা নির্জন। পাখার হাওয়ায় কোথায় যেন একটা কাগজ ওড়বার শব্দ হয় কেবল। অমিয় বসে হাই তোলে। তারপর টেবিলে মাথা রেখে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে।
–বিকেলের দিকে রজত ফিরে এসে ডাকে–বাগচী
-উঁ।
–আমার কাছে কেউ এসেছিল?
না।
–দূর! কেউ আসে নি!
–রাজেনকে জিজ্ঞেস করুন তো।
করেছি। ও তো বিশবার বাইরে যাচ্ছে চা, খাবার সিগারেট আনতে। আমার মোটর পার্টসটা দিয়ে গেল না শালা রায়চৌধুরি। কাল ডেলিভারি নিতে আসবে।
অমিয় আড়ামোড়া ভাঙে। ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা। বাইরে এখনও ফর্সা রোদ।
রজত তার চেয়ার টেনে বলে–ব্যবসার মুখে পেচ্ছাপ। ভিসা পেয়ে যাচ্ছি কাল।
কবে রওনা?
–দিন পনেরোর মধ্যে। প্রথমে ডুসেলডর্ফে যাব মাধুর কাছে। সেখান থেকে বন হয়ে কাজের জায়গায়। দাঁড়ান, আজ আমি চা খাওয়াব, সন্দেশ খাবেন?
খাব। খুব খিদে পেয়েছে। অমিয় বলে।
বেল বাজায় রজত। রাজেন এলে চা সন্দেশ আনবার পয়সা দেয়। তারপর অমিয়কে বলে–খুব দামি সিগারেট কী আছে বলুন তো?
–আপনি তো খান না।
আজ খাব।
–ইণ্ডিয়া কিংস।
রাজেনের দিকে ফিরে রজত বলে–ইণ্ডিয়া কিংস এনো, এক প্যাকেট, আর দেশলাই। বাগচী, যাওয়ার আগে একটা পার্টি দেব।
অমিয় হাসে।
–শুধু একটা ভয়, বুঝলেন বাগচী।
–কী?
এর আগে গুরুপদ গিয়েছিল। ল্যাংগুয়েজ জানত না বলে ওকে ফেরত পাঠিয়েছে। আমিও ভালো জানি না। ওদিকে ব্রজগোপালদাকে দিয়ে জার্মান ভাষায় করেসপণ্ডেন্স করেছি, নিজে শেখবার সময়ই পেলাম না। শেষে গুরুপদর মতো ফেরত পাঠাবে না তো?
–সকলের কপাল সমান না।
চেয়ারটা পিছনে হেলিয়ে একটু দোল খায় রজত। ভাবে। বলে–অবশ্য মাধুও জানত না। কোম্পানি ওকে তবু রেখে দিয়েছে।
অমিয় রজতকে একটু দেখে। অন্তত দশ বছরের ছোটো রজত। বাচ্চা ছেলে কোনো জমিতেই শেকড় নেই। কলকাতায় জন্ম-কর্ম। অমিয়র মনে হয়, কলকাতায় জন্মালে মাটির টান থাকে না। রজতের খুব ইচ্ছে, আর ফিরবে না। একটা আবছায়া স্টিমারঘাট চোখের সামনে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। অমিয় ক্যালেণ্ডারের ছবিটা দেখে। একটা মেয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে, মাথায় একটা কলসী, কোমরের কলসীটা কাত করে ধরা তা থেকে অঝোরে জল পড়ে যাচ্ছে।
রজত মুখ তুলে বলে–আমার একটা লাভ অ্যাফেয়ার প্রায় ম্যাচিওর করে এসেছিল, বুঝলেন বাগচী!