টোস্টটা আর এক-কামড় খাওয়ার জন্য মুখের কাছে এনে সোমাদি তাকায়। প্রথমটায় বোধহয় চিনতেই পারে না। তাকিয়ে থাকে।
সোমাদি, কেমন আছ?
সোমাদি টোস্টটা রেখে দিয়ে একটু চেয়ে থেকে বলে–বেরো, বেরিয়ে যা।
কেন?
লজ্জা করে না? একবছরের মধ্যে একবার মাকে দেখতে যাওয়ার সময় হয়নি? কত বড়ো অসুখ গেল মা-র, তোকে দেখার জন্য আকুলি-বিকুলি, তিনটে চিঠি দিলাম, একটা উত্তরও দিসনি। বেরো–কেন এসেছিস?
তুমি কত মাইনে পাও?
তাতে কি দরকার? চালাকি ছাড়।
চালাকি না। সত্যিই জিজ্ঞেস করছি।
ভারি তো ব্যবসা। অফিসে মাছি ওড়ে, সেই ব্যবসা করেই তোর সময় হয় না। অমানুষ!
একটা চেয়ার টেনে অমিয় বসে নিজের থেকেই। মাঝখানে মেশিন, ওপাশে সোমাদি। বলে –এর পরের জেনারেশনে আর এইসব চোটপাট শোনা যাবে না সোমাদি। যা বকাবকি করার তা তোমরাই করে নিলে।
তার মানে?
আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে একটা ফ্যামিলি আছে। স্বামী স্ত্রী আর বাচ্চা ছেলে একটা একদিন সাজগোজ করে বিকেলে কোথায় বেরোচ্ছে, ছেলেটার গাল টিপে জিজ্ঞেসা করলাম– কোথায় যাচ্ছ বাবু? সে উত্তর দিল–ঠাকুমার বাড়ি। বুঝলে সোমাদি, কথাটা সেই থেকে বুকে মাঝে মাঝে ধাক্কা দেয়। ঠাকুমার বাড়ি! মাই গড, ঠাকুরমার বাড়ি যে একটা আলাদা বাড়ি, সেখানে যে মাঝে মাঝে বেড়াতে যাওয়া যায় তা আমরা ভাবতেই পারি না এখন। ঠাকুমার বাড়ি আবার কী? ঠাকুমা যে আমাদের রক্ত-মাংস-মজ্জায় মিশে আছে–তার বাড়ি কী করে আলাদা বাড়ি হয়। এই যে তুমি আমাকে বকছ, পিসিমাকে দেখতে যাইনি বলে, এসব সম্পর্কের টান আমাদের সময়েই শেষ। এরপর পিসতুতো মামাতো ভাইবোনে দেখা হলে হয়তো হাতজোড় করে নমস্কার করবে, আপনি আপনি করে কথা বলবে। বলবে– একদিন কিন্তু আমাদের বাড়িতে যাবেন, কেমন। খুব খুশি হব।
সোমাদি একটু হাসে। বলে, তোর সঙ্গে তো আমাদের সম্পর্ক তাই দাঁড়িয়ে গেছে। একবছরে ঢাকুরিয়া থেকে বেহালা যাওয়ার সময় হয় না, কী করে বুঝব যে সম্পর্ক রাখতে চাস?
গত একবছর ধরে আমি ভালো নেই সোমাদি।
কী হয়েছে?
তুমি কত মাইনে পাও বললে না?
জেনে কী হবে?
এমনিই। কৌতূহল। বলো না।
সব কেটে ছেঁটে পৌনে আট-শো। হাসি কেমন আছে?
ভালো। গত বছর তুমি একটা স্টিলের আলমারি কিনেছ, আর একটা সিলিং ফ্যান, না?
সোমাদি হাসে–এ বছর একটা সুতোর কার্পেট কিনেছি, ড্রেসিং টেবিল করেছি, গ্যাসের উনুন কিনেছি। দেখে আসিস।
পৌনে আট-শোর মধ্যে কী করে ম্যানেজ করো? তোমার তো উপরিরও রাস্তা নেই।
এইসব জানতেই এসেছিস? হাসিকে নিয়ে কবে যাবি বল?
তোমার পোষ্যও তো কম নয়। পিসিমা, নীতা, তোমার এক জ্যাঠতুতো ভাই তোমার কাছেই থাকে, কী করে ম্যানেজ করো?
কী করব! তোরা ভাইরা তো আর মাসোহারা দিস না, ওতেই কষ্টে-সৃষ্টে ম্যানেজ করে নিই। একটা টোস্ট দিয়ে টিফিন সারি, বিড়ি সিগারেট খাই না, সাদামাটা পোশাক পরি, সিনেমা দেখি কালে-ভদ্রে, কোথাও বেড়াতেও যাই না। তোমাদের তো তা নয়। হাসির খবর কিছু বললি না, বাচ্চা কাচ্চা হবে নাকি?
-তুমি খুব কষ্ট করো, না সোমাদি?
–দূর পাগলা, তোর হয়েছে কী? এসব বলছিস কেন?
–তুমি এত কষ্ট করছ কেন?
–কেন আবার, নিজের জন্য।
–দূর! নিজের জন্য কষ্ট করে সুখ কী। কষ্ট করলে করতে হয় ভালোবাসার মানুষের জন্য। তুমি সবচেয়ে বেশি কাকে ভালোবাসো সোমাদি?
-কী জানি? তোর হয়েছে কী?
–কিছু না!
–হাসিকে নিয়ে কবে যাবি? হাসি তো আমাদের ভালো করে চিনলই না।
–যাব একদিন ঠিক। আগে বলো, তুমি কার জন্য এত কষ্ট করছ?
–বললাম তো, নিজের জন্য।
–তবে তো তুমি নিজেকে ভালোবাসো।
–বললাম তো, বাসি।
–আমি বাসি না।
–তুই হাসিকে বাসিস। ভালোবাসলেই হল।
–নিজেকে ভালোবাসলে হাসিকেও ভালোবাসা যায়। এই যে তুমি নিজেকে ভালোবাসো বললে, স্বামী-পুত্র হলে তাদেরও বাসতে, বাধা হত না। ভালোবাসা তো মাস মাইনে নয় যে টান পড়বে।
–হাসির সঙ্গে ঝগড়া করেছিস নাকি? কী হয়েছে বল? দরকার হলে আমি না হয় গিয়ে হাসিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মিটমাট করে আসি। মাত্র তিন বছর হল বিয়ে, এখনই ঝগড়াঝাঁটি হলে–
–পাকামি কোরো না। ম্যারেড লাইফ সম্পর্কে তুমি কী জান? ওই ব্যাপারে আমি তোমার সিনিয়র।
–তা হলে এই গরম দুপুরে ঘামে নেয়ে এসে ভালোবাসা-ভালোবাসা করছিস কেন? কিছু খাবি? বেয়ারা ডেকে কিছু আনিয়ে দিই। একটা ডিমভাজা–না গরমে একটু দই খাবি?
–আমার মুশকিল কী জান?
–কী?
–আমি হাসিকে ভালোবাসতাম, ব্যবসাকে ভালোবাসতাম, স্কুটারকে ভালোবাসতাম, কিন্তু এইসব ভালোবাসার মধ্যে মাঝে মাঝে একটা স্টিমারঘাট এসে পড়ছে।
–স্টিমারঘাট?
–হুঁ।
সোমাদি চেয়ে থাকে। বলে–কী বলছিস?
-খুব উঁচু বালিয়াড়ি থেকে তুমি কখনো কোনো নির্জন ফেরিঘাট দেখেছ? একটা জেটি –তারপর বিশাল ঘোলা জলের নদী–ওপারটা ধূ-ধূ করে–দেখা যায় না। দেখেছ? আমি চোখ বুজলেই দেখি।
সোমাদির মুখটা কেমন হয়ে যায় যেন। বয়েস হয়ে যাওয়া, কৃচ্ছসাধনের ছাপ-ওলা নীরস মুখ সোমাদির। তবু কয়েক পলকের জন্য যেন একটা কোমলতা গাছের ছায়ার মতো মুখে খেলা করে। মুখের কর্কশ লেখাগুলি লাবণ্যের সঞ্চারে হঠাৎ ডুবে যায়।
–কোন স্টিমারঘাটের কথা বলছিস? কলকাতার গঙ্গা, নাকি গোয়লন্দ, আমিনগাঁতেও ফেরিঘাট দেখেছিলাম।