সোনাদা তাকিয়ে থাকে।
এ কি মৃত্যুর-প্রতীক নাকি? অমিয় বলে।
ইয়ার্কি হচ্ছে?
ইয়ার্কি নয় সোনাদা। কাজকর্মে, ঘুরতে ফিরতে হঠাৎ হঠাৎ চোখের সামনে ওই বালিয়াড়ি, আর বালিয়াড়ির পর জেটি, জল–এইসব ভেসে ওঠে।
সোনাদার চোখ হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ব্যস্ত সোনাদা একটু হেলান দিয়ে বসে। টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে ইণ্ডিয়া কিংসের সোনালি প্যাকেটটা তুলে নিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। মৃদু ধোঁয়ার গন্ধ অমিয়র নাকে এসে লাগে। সোনাদার সামনে খায় না, নইলে এই মুহূর্তে তারও একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যৌথ পরিবারের শিকড়-বাকড় সব রয়ে গেছে ভিতরে। সোনাদার সামনে কোনোদিনই সিগারেট খাওয়া যাবে না।
সোনাদা বলে–এ সবই নস্টালজিয়া। আমারও হয়। দেশের বাড়িতে করমচা তলার ছায়ায় মাটির ওপর শ্যাওলা গজাত। সেই ঠাণ্ডা জায়গাটার কথা হঠাৎ কেন যে মনে পড়ে।
অমিয় মাথা নাড়ে-না এটা শৈশব-স্মৃতি নয়। স্টিমারঘাট আমি আর কবার দেখেছি। দু তিন বার বড়ো জোর। তারপরই তো কলকাতায় পার্মানেন্ট চলে এলাম। তা ছাড়া সেই স্টিমারঘাট তো দেশে যাওয়ার গোয়ার্লন্দী ঘাট নয়। এটা কেমন যেন ধু-ধু বালুর চর, নির্জন অথৈ ঘোলা জল, ওপারটা দেখা যায় না।
সোনাদা হাসে। বলে–ভালো খাওয়া-দাওয়া কর। হাসিকে নিয়ে কিছুদিন বাইরে-টাইরে ঘুরে আয়।
অমিয় অবাক হয়ে বলে-কেন?
তাহলে ওসব সেরে যাবে।
সারাতে চাইছে কে? আমার তো খারাপ লাগে না। কলকাতার ভিড়ভাট্টা, গরম, ঘাম, কাজকর্মের ভিতরে মাঝে মাঝে হঠাৎ ছুটি পেয়ে একটা অচেনা স্টিমারঘাটে চলে যাই, বালিয়াড়িতে বসে থাকি, বেশ লাগে। একে সারাব কেন? শুধু জানতে চাইছি, ব্যপারটা কী। তুমি জানো?
উত্তর দেওয়ার সময় পায় না সোনাদা। স্টেনোগ্রাফার পার্সি মেয়েটি ঘরে ঢোকে। লম্বা ফর্সা, ভাঙাচোরা মুখ। তবু মুখে একটা অদ্ভুত শ্ৰী আছে। দারুণ একখানা বাটিকের শাড়ি পরনে। মেয়েটা সোনাদার ডানদিকে গিয়ে নীচু হয়ে একটা টাইপ করা চিঠি দেখায়। কথা বলাবলি হয়। ততক্ষণ অমিয় মেয়েটার শাড়িটা দেখে। হয়তো-বা এরকম শাড়িতে হাসিকে ভালো মানাত। হাসির কথা মনে পড়তেই অমিয়র একধরনের শারীরিক কষ্ট হয়। বুক পেট জুড়ে একটা তীক্ষ্ণ বেদনার আভাস পাওয়া যায়। দম বন্ধ হয়ে আসে। বুক ধড়ফড় করে। একটা চেক-আপ বোধহয় অমিয়র দরকার ছিল। বয়স পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ, ইররেগুলার জীবন, অতিরিক্ত চা আর সিগারেট, ব্যবসার উত্তেজনা, শক, সব মিলিয়ে ভিতরটা ভালো থাকার কথা নয়। হাসিকে এই শাড়িটায় বোধহয় এখনও মানায়। নীলের ওপর হলুদ বাটিকের কাজ। পকেটে এক-শোর কাছাকাছি টাকা আছে। বাজার ঘুরে একবার খুঁজে দেখবে নাকি শাড়িটা। অবশ্য তা আর হয় না। হাসি বড়ো অবাক হবে, তাকিয়ে থাকবে বা দু-একটা বিদ্রুপাত্মক কথাও বলতে পারে। দরকার নেই। হাসি নিষ্ঠুর। তার হৃদয় নেই।
মেয়েটা ফাইলিং ক্যাবিনেটে কাগজপত্র ঘাঁটে। সোনাদা আবার কাজকর্মে ডুবে যায়। একজন দুজন করে অফিসে লোকজন আসে। সুন্দর পোশাকের চটপটে লোকেরা। সোনাদা হাত বাড়িয়ে হ্যাণ্ডশেক করে, চমৎকার ইংরেজিতে কথা বলে। বিজনেসের পিক-আওয়ার। সোনাদার দম ফেলার সময় নেই।
এক ফাঁকে অমিয় বলে–সোনাদা, উঠি।
কাগজপত্র ঘেঁটে কী একটা খুঁজে পায় সোনাদা। সেটা দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ তুলে অমিয়কে বলে–সামনের সোমবার নিন্টুর জন্মদিন। তোর বউদি হয়তো হাসিকে খবর দিয়েছে। তবু বলে রাখছি, বিকেলের দিকে হাসিকে নিয়ে চলে যাস, রাতে খেয়ে একেবারে ফিরবি।
আচ্ছা।
তোর স্টিমারঘাটের ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখব।
অমিয় হাসে। জন্মদিনে যাওয়া হবে না। স্টিমারঘাটের কথা সোনাদা ভুলে যাবে।
ব্যাঙ্কটা থেকে বেরোতেই জ্বরো কলকাতা চেপে ধরে। কী তাপ রোদের। গুমোট।
অমিয় তার স্কুটার চালু করে। কোথায় যাবে, ভেবে পায় না, তবু যায়। যেতে থাকে।
টিফিন। কিন্তু টিফিনের সময়েও সোমাদি বাইরে যায় না, আড্ডা মারে না। নিজের জায়গায় বসে থাকে। প্রকান্ড হলঘরের একধারে টাইপিস্টদের সারি সারি মেশিন। সব খালি। কেবল সোমাদি ঠিক বসে আছে। ডান হাতে একখানা এক-কামড় খাওয়া টোস্ট, আলতোভাবে ধরা, বাঁ হাত মেশিনে ছোবল মারার জন্য উদ্যত। অমিয় এগিয়ে যেতে যেতে শুনল টুক করে মেশিনের একটা অক্ষর লাফিয়ে উঠল। অমিয়র করুণা হয়।
সোমাদির বয়স পঁয়তাল্লিশের নীচে নয়। সিঁথির কাছে চুল পাতলা হয়ে এসেছে। চোখে প্লাস পাওয়ারের চশমা! রোগা গড়নের বলে বয়স খুব বেশি দেখায় না, কিন্তু দীর্ঘদিনের ক্লান্তির ছাপ আছেই। নাকের দু-ধার দিয়ে গভীর রেখা নেমে গেছে, মেচেতার ছোপ ধরেছে মুখে। বছরে বড়োজোর এক দু-দিন ছুটি নেয়। চোদ্দো বছর টানা চাকরি করছে আয়রন অ্যাণ্ড স্টিল কন্ট্রোলে, তবু চাকরি পাকা হয়নি। কন্ট্রোল উঠে যাবে বলে চাকরি কারোরই পাকা নয় এখানে। ওর বিয়ের জন্য কেউ তেমন করে চেষ্টাই করল না। পিসেমশাই মারা যাওয়ার পর একটা চাকরিতে ঢুকেছিল, তারপর চাকরিই করে গেল। বার দুই দু-টি ছেলেকে বোধহয় ভালো লেগেছিল। তাদের একজন ছিল ভিন্ন জাতের, অন্যজনের ছিল কম বয়স। হল না। হবেও না। সোমাদি তা জানে বলেই কোথাও আর যায় না। মনপ্রাণ দিয়ে চাকরি করে! ছুটি পেলে হাঁফ ধরে যায়।