অমিয় স্কুটার থেকে নেমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্কটায় ঢুকে যায়। সোনাদার কাছে কোনো কাজ নেই। তবু একবার অনেকদিন বাদে দেখা করে যেতে বড্ড ইচ্ছে করছে। মনটা ভালো নেই।
কাউন্টারে ভীড়। অজস্র সুন্দর কাউন্টারে ছাওয়া চারদিক। রঙিন দেওয়াল, টিউবলাইট –সব মিলিয়ে ব্যাঙ্কটার ভিতরটা বড়ো চমৎকার।
জিজ্ঞেসা করতেই একজন পিয়োন সোনাদার ঘর দেখিয়ে দেয়। ঘষা কাচের পাল্লা। বাইরে টুলে বেয়ারা বসে আছে। একটা টেবিলের ওপর সাজানো স্লিপ, ডটপেন। নিজের নাম লিখে অমিয় স্লিপ পাঠায়। একটু পরে বেয়ারা এসে ডাকে।
প্রকান্ড টেবিলের ওপাশে সুন্দর পোশাকের সোনাদাকে প্রথমটায় আত্মীয় বলে ভাবতে কষ্ট হয় তার। গোলাপি রঙের টাক মাথায়, নীলাভ কামানো গাল, খুব ব্যস্ত।
একবার চোখ তুলে আবার কাগজপত্রে ডুবে গেল। বসতেও বলল না। অমিয় একটু হেসে নিজেই বসে।
সোনাদা ওইরকমই। বসতে বলে না। জানে, বসতে বলার কিছু নেই। অমিয় তো বসবেই। এটা তার সোনাদার ঘর নয় কী?
ছোটোবেলা থেকে তারা ভাই-বোনরা একে অন্যকে আপন বলে ভাবতে শিখেছিল। যৌথ পরিবার ওই একটা রক্তের গূঢ় সম্পর্ক তৈরি করে দিয়ে গেছে। এ জীবনে ওটা আর ভাঙবে না।
সোনাদা একবার একফাঁকে প্রশ্ন করে–শরীরটা দেখছি শেষ করেছিস?
হুঁ।
কেন?
শরীরটা ভালো নেই।
কোম্পানি লালবাতি জ্বালেনি তো?
জ্বালছে। জ্বা
লাই উচিত। তখন যদি ব্যাঙ্কের চাকরিটা নিতিস, আজ কত মাইনে হত জানিস?
কত?
হাজার খানেকের ওপরে। গর্দভ।
মাসে ওর চেয়ে অনেক বেশি রোজগার আমি করেছি। ব্যবসা বলে তোমরা গুরুত্ব দাও না। বাঁধা মাইনের লোকেরা ব্যবসাকে ভয় পায়।
সোনাদা ভ্রূ কুঁচকে একটু তাকায়। কোথায় একটা গোপন বোতাম টেপে, বাইরে রি-রি করে বেল বাজে। বেয়ারা এলে সোনাদা চা আনতে বলে। তারপর আবার কাজেকর্মে ডুবে যায়।
ঠাণ্ডা ঘরখানা। অমিয়র ঝিমুনি আসে।
সোনাদা আবার চোখ তুলে তাকে দেখে, হঠাৎ জিজ্ঞেস করে–প্রবলেমটা কী?
তুমি বুঝবে না। অমিয় শ্বাস ছাড়ে, তারপর বলে–সোনাদা, তুমি কী প্রমোশন পেয়েছ?
চাকরিতে থাকলে প্রমোশন হয়। তার মতো ব্যবসাদাররা চিরকাল ব্যবসাদার থেকে যায়।
তুমি কী খুব বড়ো পোস্টে আছ?
সোনাদা হাসে। মাথা নাড়ে।
তাহলে আমার ব্যবসার জন্য তোমার ব্যাঙ্ক থেকে কিছু ধার পাইয়ে দাও না!
তোকে ধার দেবে কেন? ইণ্ডাষ্ট্রি বা এগ্রিকালচার হলেও না হয় কথা ছিল।
যদি সিকিউরিটি দেখাই, যদি হাই ইন্টারেস্ট দিই?
সোনাদা ভ্রূ কুঁচকে বলে–তোর আবার সিকিউরিটি কী? একটা পুরোনো স্কুটার, ত্রিশ নম্বর ধর্মতলায় একখানা ভাগের অফিস। আর কী আছে তোর? বড়জোর একখানা রিফিউজি সার্টিফিকেট, তা সেখানাও বোধহয় হারিয়ে ফেলেছিস! কাজে লাগাতে জানলে রিফিউজি সার্টিফিকেটও একটা মস্ত অ্যাসেট–কিন্তু তা তুই লাগালি কোথায়?
অমিয় চুপ করে থাকে।
সোনাদা আবার জিজ্ঞাসা করে–প্রবলেমটা কী?
অমিয় উত্তর দেয়–তুমি বুঝবে না। মানুষ কতরকম গাড্ডায় যে পড়ে সোনাদা!
তোর গাড্ডাটা কী রকম?
অমিয় শুধু হাসে। চারদিকে একবার তাকায়। যে চেয়ারে সে বসে আছে তা ফোম রবারের গদিওয়ালা, টানলে শব্দ হয় না, ভীষণ ভারী। টেবিলখানা লম্বা এল-এর মতো। ঘষা কাচের দরজা, ঢেউখেলানো কাচ দিয়ে তৈরি ঘরের পার্টিশন। ওপাশে লোকজন চললে কাচের ঢেউয়ে বিচিত্র প্রতিবিম্ব দেখা যায়। এই একখানা চেম্বার করতেই ইন্টিরিয়র ডেকরেটর অন্তত দশ বিশ হাজার কি তারও বেশি নিয়েছে। এ-রকম একখানা অফিস-ঘর বানাবার ইচ্ছে তার অনেকদিনের কিন্তু হবে না আর। এ-রকম নিস্তব্ধ, কাচের ঘর, মাছি উড়লে সেখানে শব্দ পাওয়া যায়, এ-রকম ঠাণ্ডা ঘর, ফোম রবারের গভীর তলিয়ে-যাওয়া গদি, বিচিত্র ডিজাইনের সেক্রেটারিয়েট টেবিল, আলো-এইসব আর কোনোদিন হবে না।
লাঞ্চে তুমি কী খাও সোনাদা?
তোর মুন্ডু।
এই ঘরটা সাজাতে কত খরচ পড়েছে?
তোর মতো দশটা ব্যবসাদারকে বিক্রি করলে যত ওঠে।
এরা তোমায় বাড়িভাড়া দেয়? গাড়ি?
সোনাদা তাকে গ্রাহ্য না করে কাজ করে যায়। কিন্তু সোনাদার কপালে কয়েকটা দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দেয়। কাজ করতে করতেও এক-আধবার চোরা চোখে অমিয়কে দেখে নেয়।
অমিয় বলে–উঠি।
বোস। প্রবলেমটা কী বলে যা।
কিছু না।
টাকা সত্যিই চাস?
অমিয় মাথা নাড়ে–না।
দরকার হলে ম্যাক্সিমাম হাজার খানেক নিতে পারিস। ব্যাঙ্কের টাকা নয়, আমার টাকা।
কোনোদিন নিয়েছি?
সোনাদা চুপ করে থাকে।
অমিয় বলে–তুমি যদি সাপ্লায়ার হতে, কিংবা সুদখোর মহাজন, কি আমার ক্লায়েন্ট, তো নিতাম। তুমি আমার সোনাদা, কিন্তু আমার ব্যবসার কেউ নও। তোমার কাছ থেকে নিলে আমি তোমার আর পাঁচজন আত্মীয়ের মতো নীচু হয়ে যাব।
তার মানে?
অমিয় হাসে–আমাদের আত্মীয়দের মধ্যে তুমিই সবচেয়ে সাকসেসফুল। তোমার কাছ ঘেঁষে বহু আত্মীয় ঘোরাফেরা করে, আমি জানি। কিন্তু তুমি জেনে রেখো, আমি তাদের দলে নই।
সোনাদা একটু হাসে।
সোনাদা, আমার একটা প্রবলেমের কথা তোমাকে বলব? শুনবে ঠিক?
সোনাদা ভ্রূ কুঁচকে তাকায়। ছোট্ট একটা নড করে।
আমি প্রায়ই একটা স্টিমারঘাটকে দেখতে পাই।
সোনাদা নড়ে-চড়ে বসে বলে–কীরকম?
আমি যেন উঁচু বালির চড়ায় বসে আছি। অনেক দূর পর্যন্ত বালিয়াড়ি গড়িয়ে গেছে– আধমাইল-একমাইল-তারপর ঘোলা জল–একটা জেটি–প্রকান্ড নদী দিগন্ত পর্যন্ত। কখনো কখনো দেখি, রাতের স্টিমারঘাট-কেবল বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলে, জেটির গায়ে জলের শব্দ–ওপারে ভীষণ অন্ধকার। কেন দেখি বলো তো?