অমিয় হাসে।
কখনো কখনো শূন্য ঘরে, তার টেবিলের ওপর বিশাল সিংহ এক লাফ দিয়ে উঠে আসে। ধক ধক করে জ্বলে তার শরীর, পঞ্জরসার দেহ, পিঙ্গল কেশর। মুখে বৈরাগ্য, চোখে দূরের প্রসার। পুরুষের এরকমই হওয়ার কথা ছিল। কে তাকে শেখালো নারী-প্রেম, হাঁটু গেড়ে প্রণয়ভিক্ষা, মোলায়েম ভালোবাসার কথা! অপরূপ মগ্ন হয়ে দেখে অমিয়।
তারপর টাইপরাইটার টেনে নিয়ে বসে।
–আপনি বার বার কেন একটা স্টিমারঘাটের কথা বলেন জামাইবাবু?
–আমি বলি না। অমিয় বলে। তুমি ওর কাছ থেকে কখনো শুনে নিও।
–কী করে শুনব! আমি কাল চলে যাচ্ছি।
–শুনলে ভালো করতে।
–কেন?
জামাইবাবু টেলিফোনের অন্য প্রান্তে শ্বাস ফেলে।
-হাসি, আমাদের বয়স হয়ে গেল।
হঠাৎ একথা কেন?
–কী জানি! আজকাল হঠাৎ কাজকর্মের মাঝখানে বয়সের কথা মনে পড়ে। আর মনে পড়ে…
–কী?
–স্টিমারঘাট…তুমি সাবধানে যেও হাসি। গঙ্গার ওপর ব্রিজটা যে কবে ওরা শেষ করবে।
–আমি পাগল হয়ে যাব জামাইবাবু, স্টিমারঘাটের কথাটা আগে বলুন। কোন স্টিমারঘাট?
ফারাক্কা।
–না, ফারাক্কার কথা আপনি বলছেন না।
জামাইবাবু চুপ করে থাকে।
-বলবেন না?
—তুমি অমিয়র কাছে শুনো।
–ওর সঙ্গে আমার দেখা হবে কখন? ও অনেক রাতে ফেরে, খুব সকালে বেরিয়ে যায়।
–কাল স্টেশনে অমিয় যাবে না?
–বলেছিল তো যাবে। অফিসে কাজ আছে, সেখান থেকেই সম্ভব হলে স্টেশনে যাবে।
–তবে আর সময় হবে না।
–কীসের?
–ষ্টিমারঘাটের কথা শোনার। ফোন রেখে দিচ্ছি হাসি…
হাসি রিসিভার রেখে দেয়।
পরমুহূর্তেই আবার তুলে দ্রুত ডায়াল করে।
-হ্যালো আমি অমিয় বাগচীর সঙ্গে কথা বলতে চাই। এক্ষুনি, জরুরি দরকার।
একটু অপেক্ষা করতে হয়। তারপর অমিয়র গলা ভেসে আসে–বাগচী বলছি।
–শোনো, তোমার সঙ্গে আমার একটা জরুরি কথা আছে।
–কী কথা?
–তুমি আমাকে একটা কথা কোনোদিন বল নি।
–কী?
–স্টিমারঘাটের কথা। সবাইকে বলেছ, আমায় ছাড়া। একবার আমাকে বলবে?
–আমার সময় নেই হাসি।
–কেন?
–আমি খুব ব্যস্ত।
–কেন ব্যস্ত?
–অনেক কাজ হাসি। আমাদের সময় তো বেশি নয়।
–বলবে না?
–সময় বড়ো কম হাসি।
–স্টিমারঘাটের অর্থ কী?
–কী করে বলব। আমিই কি জানি?
–কী আছে সেখানে?
–কিছু নেই। শুধু একটা উঁচু বালিয়াড়ি, ধু-ধু বালি গড়িয়ে নেমে গেছে, একটা সাপের খোলস উলটে পড়ে আছে। বালির শেষে দূর থেকে একটা কালো জেটি দেখা যায়। তারপর জল। সে খুব অথৈ জল, অনন্ত জল, প্রকান্ড এক নদী, তার ওপর কালো আকাশ ঝুঁকে আছে…হাসি স্তব্ধ হয়ে থাকে।
এর মানে কী?
–আমি জানি না। তবে মনে হয়, ওখানে একদিন সকলের দেখা হবে।
–কেন
—
-কেন?
—
—কেন?
—
-কেন?
প্যাটারসনের অর্ডারটা আজ বেরিয়েছে।
সকাল থেকেই অমিয় ঘুরছে বাজারে। ভাদ্র মাস পড়ে গেল প্রায়। রোদের তাপ অসম্ভব। মাঝে মাঝে ধুলোর ঝড় ওঠে। ঘুর্ণ হাওয়ার মতো হাওয়া দেয়। হাঁটতে খুবই কষ্ট হয় অমিয়র। তবু সে হাঁটে। মাঝে মাঝে স্পষ্ট দেখতে পায় সামনে, ভিড় ভেদ করে চলেছে এক প্রকান্ড সিংহ। পিঙ্গল কেশর, পঞ্জরসার দেহটিতে স্তম্ভিত বিদ্যুৎ, গায়ে বৈরাগ্যের ধূসর রং, চোখে দূরের প্রসার। সিংহ মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখে নেয়। দেখে নেয়, অমিয় ঠিকঠাক চলছে কিনা।
অমিয় চলে। সাপ্লায়ারদের কাছে ঘোরে। দোকান যাচাই করে। সে আছে। থাকবে।
স্টিমারঘাটের ছায়াটা চকিতে ভেসে ওঠে চোখে। মিলিয়ে যায়। দেখা হবে, একদিন সকলের সাথে দেখা হবে।
দুপুরের দিকে অফিসে ফিরে একটা সিগারেট মুখে টাইপরাইটারের সামনে বসে অমিয়। টাইপ করতে থাকে।
কল্যাণ ঘরে ঢুকেই বলে, এ কী বাগচী?
—-কী।
–আপনি এখনও যাননি?
–কোথায়।
কাল যে বলছিলেন আজ দার্জিলিং মেলে আপনার স্ত্রী চলে যাচ্ছেন!
–ওঃ।
ভুলে গিয়েছিলেন?
অমিয় লজ্জিত হয়ে হাসে। সে ভুলে গিয়েছিল। হাসির কথা তার মনেই ছিল না।
–কটা বাজে মুখার্জি?
বারোটা চল্লিশ। পঞ্চাশে ট্রেন ছেড়ে যাবে।
–তাহলে আর গিয়ে কী হবে!
–উঠুন তো। নীচে স্কুটার রয়েছে…তাড়াতাড়ি করুন, হার্ড লাক–পেতে পারেন। উঠুন, উঠুন…
দেরিই হয়ে গেল অমিয়র।
স্কুটার থেকে নেমে সে দ্রুত পায়ে উঠে এল স্টেশনের হলঘরে। আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে আসছে মানুষ–যারা প্রিয়জনদের বিদায় জানাতে এসেছিল। কোলাপসিবল গেটের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অমিয় শূন্য লাইনটা দেখে। বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়, লাইনটা চকচক করছে। কয়েকজন লোক বেরিয়ে আসছিল। তারা সরে যেতেই অমিয় দেখতে পেল হাসি দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে সুটকেস। সে একা।
–কী হল?
হাসির মুখ চিন্তান্বিত। কপালে ভ্রূকুটি। কেমন যেন আস্তে, আস্তে, চিন্তা করে করে বলল, আমি ট্রেনটা ধরতে পারিনি।
-কেন?
পারলাম না।
-কেন?
হাসি খুব বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। বলে–কী জানি! আমাকে কখনো জিজ্ঞেস কোরো না।
অমিয় একটু হাসে।
আজকাল অমিয় যখন সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর ঘুমোয় তখন তার স্বপ্নের মধ্যে উপর্যুপরি সিংহের ডাক শোনা যায়।
মেঘগর্জনের মতো সেই ডাক। মাটিতে লেজ আছড়ানোর শব্দ হয়। পিঙ্গল কেশর, পঞ্জরসার দেহে স্তম্ভিত বিদ্যুৎ, গায়ে ধূসর রঙের বৈরাগ্য, চোখে দূরের প্রসার–সিংহেরা তার ভিতরে ঘুরে বেড়ায়। উপর্যুপরি ডাক দেয়, মেঘ-মাটি কেঁপে ওঠে। ঘুমের মধ্যে অমিয় হাসে।