কল্যাণ টেবিলের ওপর পা তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে! তৃষ্ণা কোম্পানি দাঁড়িয়ে গেছে। দু-জন কর্মচারী আউটডোরে ঘুরে বেড়ায়, কল্যাণকে কেবল অফিসটা দেখতে হয় আর ইনকাম-ট্যাক্স। কোম্পানি দাঁড়িয়ে গেলে আর তেমন ভাবনা নেই। রজতের টেবিল খালি। বড়ো একটা থাকে না রজত, প্রচন্ড খাটে আর ঘোরে। দাঁড়িয়ে যাবে।
অমিয় নিঃশব্দে বসে থাকে কিছুক্ষণ। ভাবনাচিন্তা করার মতো মাথার অবস্থা নয়। মনে হয় বেশি ভাবতে গেলেই মাথায় সমুদ্রের মতো বিশাল ঢেউ উঠে সে পাগল হয়ে যাবে।
বসে থাকলে এরকম হবেই, অমিয় তাই উঠল।
কল্যাণ একবার তাকিয়ে বলল–কোন দিকে যাচ্ছেন?
যাই একবার প্যাটারসনে। ওদের কাল মিটিং গেছে। লাহিড়ী বলছিল একটা ডিসিশন হবেই। যদি কিছু হয়ে থাকে দেখে আসি।
মিশ্রিলাল কত পায়?
ন-শো।
গতকাল আমি একটা পেমেন্ট পেয়েছি। শচারেক দিতে পারি। মিশ্রিকে আপাতত কাটাবেন, কিছু দিয়ে হাতে রাখুন।
কেন?
ফুড সাপ্লাইয়ের টেণ্ডারটা ধরে রাখুন। মিশ্রিকে কিছু খাওয়ালে ক্রেডিটে আবার মাল দেবে।
আপনি তো দু-শো অলরেডি পান।
দেবেন এক সময়ে। পালাবেন কোথায়?
আবার চোখ বোজে। কল্যাণ ও-রকমই। খুব মহৎ কাজ ও খুব অবহেলার সঙ্গে করে। অমিয় ঠিক কৃতজ্ঞতা বোধ করতে পারে না। মনটা সেরকম নেই। সেনগুপ্ত পালিয়েছে, হাসি চলে যাচ্ছে। ব্যবসা ঝুল।
নীচে এসে স্কুটারটা চালু করে সে। ভীড় কাটিয়ে ধীরগতিতে এগোয়।
কাচের টেবিলে ছায়া পড়তেই লাহিড়ী মুখ তোলে।
ভালো খবর মশাই।
কী?
আবার অর্ডার পাবেন। আপনার টেণ্ডার আমরা নেব। কাল খুব লড়ালড়ি হল আপনার জন্য।
কত টাকার অর্ডার?
কম। হাজার পাঁচেক। কিন্তু ব্যাড বুকে আছেন এখন, এই অর্ডারই আপাতত পাঁচলাখের সমান। মেশিনগুলি যদি পালটাতে না পারেন তবে অন্তত মেরামত করে দেবেন, বিল কিছু ছাঁট-কাট হবে। সাত হাজারের জায়গায় হাজার চারেক পেয়ে যাবেন। কিন্তু সেটা পাবেন মেশিন মেরামতের পর।
অমিয় ম্লান মুখে বসে থাকে। খবরটা ভালোই। খুব ভালো। কিন্তু পাঁচ হাজারের অর্ডার ধরাও মুশকিল। পেমেন্টটা আটকে রইল।
লাহিড়ী চা বলল। তারপর জিজ্ঞেস করে–কী হয়েছে, খারাপ দেখছি যে!
কিছু না। শরীরটা ভালো নেই।
বয়স কত?
পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ।
লাহিড়ী গম্ভীর ভাবে বলে–ড্রিঙ্কস?
একটু-আধটু।
মেয়েছেলে?
নীল।
স্মোক?
দিনে চল্লিশ পঞ্চাশটা।
চেক-আপ করান। হার্ট, ব্লাড, ইউরিন।
চা-এসে যায়। দামি চায়ের গন্ধ। ভালো-লাগে অমিয়র। আস্তে আস্তে চেখে চেখে খায়। প্যাটারসন ওগিলভি অ্যামালগামেশান পুরোনো কোম্পানি। ব্রিটিশারদের হাত থেকে গত বছর কিনল এক পাঞ্জাবি। দশ বছর ধরে প্যাটারসনের সঙ্গে ব্যবসা করছে অমিয়। সকলের সঙ্গেই চেনা হয়ে গিয়েছিল, গুডউইল তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেনগুপ্ত ডুবিয়ে দিয়ে গেল। পুরোনো সাপ্লায়ার বলে প্যাটারসন অমিয়কে ছাড়ল না, কিন্তু নীচু নজরে দেখবে এখন, বেশি টাকার অর্ডার দিতে ভয় পাবে।
লাহিড়ীর খাঁই বেশি নয়। ওয়ান পার্সেন্ট নেয় বিল থেকে। অন্য পারচেজ-অফিসারদের বায়নাক্কা অনেক। সেই তুলনায় লাহিড়ী দেবতা।
অমিয় উঠে বলল–অনেক ধন্যবাদ।
লাহিড়ী হাসল, বলল–সেনগুপ্তর খবর কী?
খবর নেই।
ক্যাপিটাল তুলে নিয়ে গেছে?
হ্যাঁ!
ওসব মাল আমরা চিনি। আপনিই চিনতে পারেননি।
অমিয় দীর্ঘশ্বাসটা চেপে রাখে।
নীচে এসে আবার স্কুটার চালু করে অমিয়। কোথাও যাওয়ার নেই। সব জায়গায় পাওনাদার বসে আছে। হাজার দশ-বারো টাকার ক্রেডিট বাজারে। গোটা দুই বিলের পেমেন্ট সামনের সপ্তাহে পাওয়া যাবে। তার আগে অমিয়র কোথাও যাওয়া হবে না। পেমেন্ট পেলেই কিছু ধার শোধ হবে। হাতে কিছুই থাকবে না।
প্যাটারসন ওগিলভি অ্যামালগামেশন পিছনে ফেলে অমিয়র স্কুটার ধীরগতিতে, ভ্রমরের গুঞ্জন তুলে চলতে থাকে। উদ্দেশ্যহীন।
চললে বাতাস লাগে। থেমে থাকলে গুমোটা একটা পেট্রোল পাম্পে থামতেই গুমোটটা টের পায় সে। তিনটে গাড়ি তেল নিচ্ছে কাজেই একটু অপেক্ষা করতে হয় তাকে। কাঁচা পেট্রোলের গন্ধে একটা মাদকতা আছে। গন্ধটা বরাবর ভালো লাগে তার। মন চনমন করে ওঠে। বুক ভরে সে পেট্রোলের গন্ধ নেয়। ঝিমোয়। কয়েক মুহূর্তেই শার্টের নীচে ঘাম কেঁচোর মতো শরীর বেয়ে নামে। হাতের তেলে ভিজে যায়।
পিছনে একটা গাড়ি তীব্র হর্ন দেয়। অমিয় ঝাঁকুনি খেয়ে চোখ চায়। সামনের গাড়ি চলে গেছে। অমিয় এগোয়। ট্যাঙ্ক-ভরতি তেল নেয়। আবার স্কুটার ছাড়ে। উদ্দেশ্যহীন ঘুরতে থাকে।
মধ্যকলকাতার অফিসপাড়ায় কত বাড়ি তৈরি হচ্ছে। দারুণ দারুণ বাড়ি, লাখ লাখ টাকা খরচ। ভিতরে কোটি কোটি টাকার লেন-দেন।
অফিস, কোম্পানি, ব্যাঙ্ক, জীবনবিমার বাড়ির ছায়ায় ছায়ায় অমিয় তার স্কুটার চালায়। শরীরের ঘাম মরে আসে। হাসি কিছু টাকা চেয়েছে। কত টাকা তা বলেনি–স্টিলের আলমারিতে শ-তিনেক আছে মনে হয়। অমিয়র পকেটে বড়জোর শ খানেক। হাসি জানে, অমিয় এখন দড়ির ওপর হাঁটছে, তাই বেশি নেবে না বোধ হয়। হাসি টাকা চায় না। মুক্তি চায়। কিন্তু ওকে এ সময়ে কিছু টাকা দিতে পারলে অমিয় খুশি হত।
সোনাদা যে ব্যাঙ্কে চাকরি করে সেই ব্যাঙ্কটা পেরিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থামে অমিয়। বছর তিনেক আগেই সোনাদা অ্যাকাউন্টস অফিসার ছিল। এখন কি আর একটু ওপরে উঠেছে! সাহেবি ব্যাঙ্ক, একগাদা টাকা মাইনে পায় সোনাদা। কপালটা বড়ো হয়ে হয়ে অনেকটা মাথা জুড়ে টাক পড়েছিল। এখন বোধহয় টাকটা পুরো হয়ে গেছে। সোনাদা বরাবর গম্ভীর। দেখা হলে হাসে না, কথাও বেশি বলে না। পাত্তা না দেওয়ার ভাব। কিন্তু অমিয় জানে, সোনাদা মানুষটা বাইরে ওইরকম, ওর মুখে কথা কম, ভাবের প্রকাশ কম। কিন্তু এখনও অমিয়কে দেখলে ওর চোখের পাতা কাঁপে। স্নেহে, মমতায়। কত কষ্ট করেছে সোনাদা! বড়ো কষ্টে মানুষ।