–আপনার সময়টা ভালো যাচ্ছে না। সেনগুপ্তের কোনো পাত্তা পেলেন?
-না।
–কত টাকার বিল পেমেন্ট নিয়ে গেছে?
–প্রায় সাত হাজার।
–ওকে খুঁজে পেলে কী করবেন?
–কিছুই না। কেবল একটা কথা বলব
—-কী কথা?
—বলব…
অমিয় আর বলে না। বলতে পারে না। টাইপরাইটারের ওপর ঝুঁকে পড়ে তার মুখ। চোখে মেঘ। বাষ্পরাশি জমে ওঠে। সে দেখে, টাইপ করা লাইনের অক্ষরগুলো কে যেন আঙুলের টানে লেপে দিয়ে গেছে। কালো রেখার মতো দেখায়। লাইনগুলো ধীর আঁকাবাঁকা হয়ে যেতে থাকে। দুলতে থাকে। অমিয় দেখতে পায়, লাইনগুলো দুলতে দুলতে ঢেউ হয়ে যাচ্ছে। …ঢেউ আর ঢেউ। ফুলে উঠছে জল-অনন্ত অথৈ মহাসমুদ্রের মতো জল। কালো মহা আকাশ ঝুঁকে আছে তার ওপর। বালিয়াড়ি ধু-ধু করে সাদা হাড়ের মতো। গড়ানে বালি, বালির ওপর ঢেউয়ের দাগ। সাপের খোলস উলটে পড়ে আছে।
–মুখার্জি, আমি আপনাকে একটা জিনিস প্রেজেন্ট করব।
–কী?
–আমার স্কুটারটা।
–তা কেন বাগচী! এখন আপনার সময় ভালো যাচ্ছে না। প্রেজেন্ট সুসময়ে করবেন।
–এই ঠিক সময় মুখার্জি। স্কুটারটার আর আমার দরকার নেই।
কল্যাণ একটু চুপ করে থাকে–যদি দরকার না থাকে তো ওটা আমি কিনে নিতে পারি।
–না মুখার্জি, আমাদের বংশে কেউ কখনো ঘরের জিনিস বেচেনি। আমি ওটা আপনাকে দিয়ে দেব। অভাবের সময়েই দেওয়া ভালো, সুসময়ে দেওয়া হয় না।
কল্যাণ চুপ করে থাকে।
-রাজেনের কাছে টাকাটা আছে বাগচী, দরকার হলে নেবেন।
-আচ্ছা।
টেণ্ডার সিল করে অমিয় বেরোয়। মেঘ কেটে রোদ উঠছে চারদিকে পাথুরে শহর। প্রতিদ্বন্দ্বী কলকাতা। নীচে স্কুটারটা দাঁড়িয়ে আছে। অমিয় চেয়ে থাকে। তারপর স্কুটার ছাড়ে।
–লাহিড়ী।
–উ।
–টেণ্ডার দিয়ে গেলাম।
–আচ্ছা। দেখব।
–লাহিড়ী, প্যাটরসন কি এখনো আমাকে বিশ্বাস করে?
লাহিড়ী হাসে। বলে-ওসব রোমান্টিক কথা ছাড়ুন। কে কাকে বিশ্বাস করে। অর্ডার আপনি পাবেন। ঠিকমতো রেট দিয়েছেন তো, যেমন বলেছিলাম?
–দিয়েছি।
–ঠিক আছে।
অমিয় বেরোয়। ঘুরতে থাকে। মাঝে মাঝে নিজের অফিস ছুঁয়ে যায়।
–বাগচী।
উঁ?
ল্যাংগুয়েজ নিয়েই সবচেয়ে মুশকিল।
অমিয় হাসে। বলে–কেন?
রজত হাই তুলে বলে–কিছুতেই ল্যাংগুয়েজ খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ মেয়েটা রোজই মুখের দিকে চেয়ে থাকে। ভারি অস্বস্তি।
চেয়ে থাকে কেন?
–বোধহয় এক্সপেক্ট করে, জার্মানি যাওয়ার আগে আমি তাকে ফাইনাল কিছু বলে যাব। বাঙালি মেয়েদের জীবন খুব অনিশ্চিত তো। অথচ আমি কিছু বলতে পারছি না। ল্যাংগুয়েজ নিয়েই মুশকিল।
–কবে যাচ্ছেন?
–হরি সিং-এর সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করেছি। দিন কুড়ির মধ্যেই চলে যাব।
–আমাদের একা লাগবে।
–জানি। আফটার অল উই ওয়্যার কমরেডস। বাগচী, আপনার জন্য কী পাঠাব বললেন না?
ভেবে দেখি।
–সেনগুপ্তকে যদি কখনো খুঁজে পান বাগচী, গিভ হিম অ্যান এক্সট্রা কিক ফর মি। মনে রাখবেন।
অমিয় হাসে।
মিশ্রিলাল এসে চুপ করে বসে থাকে, ধৈর্য ধরে।
-বাগচীবাবু।
–জানি মিশ্রিলাল।
–আপনি তো আর কোনো অর্ডার পেলেন না! বিজনেসের কী হবে? আমি ডুবে যাব না?
বোধ হয় দূরে কোথাও মেঘ গর্জনের মতো একটা শব্দ হয়। অমিয় কান পেতে শোনে। শার্সির বাইরে আজ প্রবল রোদ। কোথাও মেঘ নেই। তবুও শব্দটা কোথা থেকে শোনে অমিয়? একবার চোখ বোজে সে। অমনি এক পঞ্জরসার দেহে স্তম্ভিত-বিদ্যুৎ সিংহ তার চোখে ছায়া ফেলে দাঁড়ায়। গভীর অরণ্যের ছায়ায় বহু দূরের সিংহ ডাকে–মেঘ-মাটি কেঁপে ওঠে।
সে বলে–ডুববে না মিশ্রিলাল। আমি আছি। থাকব।
হাসির সঙ্গে বড়ো একটা দেখা হয় না আজকাল। রাত পর্যন্ত সে বাইরে থাকে। ফিরে এসে দেখে, হাসির ঘর ফাঁকা। বোধহয় হাসি কলকাতায় তার চেনাশোনা মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে যায়, দেখে সিনেমা-থিয়েটার, বোধহয় তার নেমন্তন্ন থাকে খাওয়ার। কে জানে। মধু তাকে চা করে দেয়। জিজ্ঞেস করে-বাবু, আপনার গাড়ি!
–দিয়ে দিয়েছি একজনকে।
বুড়ো মধু বিড় বিড় করে কী যেন বলে। বোধহয় জীবনের অনিত্যতার কথা নিজেকে শোনায়।
রাত বেড়ে যায়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে। ঘুম হয় না। উঠে বসে অমিয় আলো জ্বালে। অফিসের কাগজপত্র দেখে। টেণ্ডারের খসড়া তৈরি করে। সে সময়ে ভেজানো দরজা ঠেলে হাসি আসে। নিঃশব্দে ঘরে চলে যায়। কাপড় ছেড়ে কলঘরে ঢোকে। বেরিয়ে আসে, জল খায়। শুয়ে পড়ে।
তাদের মধ্যে কোনো কথা হয় না। হাসির যাওয়ার দিন এসে গেল।
রোদের তাপ আজকাল খুব বেড়ে গেছে। অমিয়র তাই কষ্ট হয় খুব। অনেকটা হাঁটতে হয়। কল্যাণ প্রায়ই বলে–বাগচী, স্কুটারটা নিয়ে বেরোবেন।
অমিয় হাসে। নেয় না। কল্যাণ কয়েকদিনে ভালোই শিখে গেছে চালাতে। ও যখন স্কুটার চালায় তখন মুগ্ধ হয়ে দেখে অমিয়। ভালো লাগে। হিংসে হয় না।
রজতের কোনো কাজ নেই আজকাল। ব্যবসা সিল করে দিয়েছে। তবু রোজ এসে দেখা করে যায়।
কবে ফ্লাই করছেন সেন?
–বলিনি আপনাকে? বিশ তারিখ, টিকিট পেয়ে গেছি।
–বাঃ! ভালো খবর।
–বাগচী, ইউ আর সাফারিং টু মাচ।
ধারগুলো শোধ করতে হবে সেন।
পালিয়ে যান না। সেনগুপ্তকে কে আর ধরতে পেরেছে।
–ঠিক দেখা হবে একদিন…তখন? অমিয় হাসে।
–বাগচী যদি সত্যিই কেটে পড়তে চান তো ব্যবস্থা করতে পারি।
–কীরকম ব্যবস্থা?
–জব ভাউচার। তিন মাসের মধ্যে আপনাকে নিয়ে যাব।