–জানি মেসোমশাই। অমিয় বড়ো ভালো ছেলে।
পিসেমশাই শ্বাস ছেড়ে বলেন–আমি বড়ো একা হয়ে গেলাম। শেষ মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। সোমা, মাঝে মাঝে আসবি তো? অমিয় তুই?
–আসব না কেন!
–কী কথা হচ্ছিল তোদের?
সোমাদি মাথা নীচু করে বলে কিছু না মেসোমশাই, অমিয় মাঝে মাঝে একটা ফেরিঘাটের কথা বলছে–
–ফেরিঘাট! কীসের ফেরিঘাট? কী রে অমিয়?
–স্টিমার বাঁধার জেটি, জল…
-ওঃ। পিসেমশাই হাসেন–স্টিমারঘাট মনে পড়তেই খালাসিদের মাংস রান্নার গন্ধ নাকে এসে লাগে এখনও। গোয়ালন্দে পারাপারের সময়ে ওই গন্ধ যে কী ভালো লাগত। বুঝলি, বাহাদুরাবাদে একবার কাজলি মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম সরষেবাটা, কাঁচালঙ্কা দিয়ে ঝোল– তেমন আর কখনো কি খাওয়া হবে? এক কাঠা চালের ভাত তুলে ফেলেছিলাম। তুই কোন ফেরিঘাটের কথা বলছিস অমিয়? গোয়ালন্দ? নাকি…
-কী জানি! আমি ঠিক জানি না। খুব উঁচু একটা বালিয়াড়ি গড়িয়ে নেমে গেছে বহু দূর পর্যন্ত…কালো ছোট্ট একটা জেটি…নির্জন…বালিতে একটা সাপের খোলস পড়ে আছে। কেবল…আবছায়ায় জল দেখা যায়…সেকী জল…অনন্ত, অথৈ এক নদী বয়ে যাচ্ছে…
পিসেমশাই আর একটু কুঁজো হয়ে যান। একটা শ্বাস ফেলে বলেন–এখন এই বাড়িতে আমার একা কাটবে, বাদবাকি যে কটা দিন আছি। অমিয় রাত হল রে, বউমাকে নিয়ে যাবি, অনেকটা রাস্তা, এইবার বেরিয়ে পড়। সোমা, তুই তো আজ যাবি না, না?
–না।
–অমিয় আর দেরি করিস না। সোমা, বউমাকে ডেকে দে।
দিই।
-বড়ো একা লাগবে, বুঝলি অমিয়? মাঝে মাঝে বউমাকে নিয়ে চলে আসবি। দু-চারদিন করে থেকে যাবি। মনে করিস, আমি তোর এক বুড়ো ছেলে, আমার তো কেউ রইল না…
অমিয়র স্কুটার ডাকছে। গুড় গুড় গুড় গুড়। পেছনে হাসি। বাতাস সামনে থেকে পেছনে বয়ে যাচ্ছে। তবু মাঝে মাঝে এক এক ঝলক হাসির গন্ধ এসে নাকে লাগে। হাসির গন্ধ! তা তো নয় হাসির আবার গন্ধ কী? ও তো ওর খোঁপার বেলফুলের গন্ধ, সেন্ট আর প্রসাধনের গন্ধ।
হাসির মুখ দেখতে পাচ্ছে না অমিয়। কেবল তার দু-খানা হাত অমিয়র কোমর বেষ্টন করে আছে। একবার ঝুঁকে নিজের পেটের কাছে হাসির জড়িয়ে থাকা হাতের পাতাদুটি দেখল অমিয়। আঙুলে আংটি ঝলসে ওঠে। মোমে মাজা আঙুলগুলি কী নরম হয়ে লেগে আছে তার পেটে।
হাসি দুরন্ত শ্বাসের সঙ্গে বলে–আরও জোরে চালাও না।
—কেন?
–জোরে না চালালে স্কুটারে ওঠার আনন্দ কী।
–হাসি, আমার স্কুটারটা পুরোনো হয়েছে। স্পিড নেয় না।
–পচা, তোমার স্কুটারটা পচা।
অমিয় হাসে। তিন, সাড়ে তিন বছর আগে ক্যাথিড্রাল রোডে এই স্কুটারে…
-জ্যোৎস্না ফুটেছে কেমন, দেখছ?
–হুঁ।
–ঠিক দুধ-ভাতের মতো জ্যোৎস্না, আমার খেতে ইচ্ছে করে।
–হাসি তুমি কবে যাচ্ছ?
–তেরোই।
–তোমার যদি টাকার দরকার থাকে…
–সামনে ওটা কী, ওই উঁচু মতো?
–গড়িয়াহাটা ব্রিজ।
ওমা! ওর ওপর দিয়ে তো রোজই যাই আসি, কই অত উঁচু বলে তো মনে হয় না, ঠিক টিলার মতো দেখাচ্ছে দেখো। চা-বাগানে আমরা ছেলেবেলায় টিলা থেকে ছুটে নামতাম -একবার দৌড় শুরু করলে আর থাকা যায় না, কেবলই গতি বেড়ে যায়।
–হুঁ।
–তোমার স্কুটারটা পচা। আর একটু জোরে চালাও না।
—কেন?
–আমার স্পিড ভালো লাগে।
গুড় গুড় করে স্কুটার ডাকে। গড়িয়াহাটা ব্রিজের গোড়া থেকে চড়াই ভাঙে। অমিয় স্পষ্টই টের পায় তার বয়স্ক স্কুটারটার এই চড়াই ভাঙতে কষ্ট হচ্ছে। খুব বেশিদূর নয় আর সে মনে মনে তার স্কুটারকে বলে, আর একটু কষ্ট করো স্কুটার। তারপর অন্ধকার সিঁড়ির নীচে তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোবে।
–ব্রিজের ওপর ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়াবে?
—হাসি, অনেক রাত হয়েছে।
-কটা বাজে?
বারোটা চল্লিশ।
–হোকগে। তুমি দাঁড়াও।
-ব্রীজের ঠিক ওপরটায় বাতাসের জোর বেশি। আকাশের কাছাকাছি উঠে তারা দাঁড়ায়। হাসি রেলিংয়ের কাছে চলে যায়। ডেকে বলে–দেখো, কত দূর পর্যন্ত কী ভীষণ জ্যোত্সা। সব দেখা যাচ্ছে। এত রাতে কলকাতা কখনো দেখিনি।
অমিয় বাতাসে সিগারেট ধরাতে পারছিল না। বার বার দেশলাইয়ের কাঠি নিভে যাচ্ছে। সে স্কুটারের ওপর না-ধরানো সিগারেট মুখে নিয়ে বসে রইল। হাসি তাকে ডাকে না। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে হাসি একা জ্যোৎস্নায় প্লাবিত অনন্ত শহরটি দেখে মুগ্ধ চোখে। এখন যদি নিঃশব্দে অমিয় তার স্কুটারকে ব্রিজের ঢালুর ওপর দিয়ে গড়িয়ে দেয়, যদি চলে যায়, তাহলে হাসি অনেকক্ষণ টেরই পাবে না যে অমিয় চলে গেছে। কিছুক্ষণ পরে মুখ ফিরিয়ে স্কুটার এবং অমিয়কে না দেখে একটুও অবাক হবে না হাসি। তার মনে পড়বে না যে, এই ব্রিজের ওপর সে অমিয়র সঙ্গে এসেছিল, তার স্কুটারে। হাসির মনেই পড়বে না।
না-ধরানো সিগারেট মুখে অমিয় অপেক্ষা করে। বাতাসে আকাশজোড়া এক বৃক্ষ নড়ে। বকুলের মতো খসে পড়ে তারা। অমিয় অপেক্ষা করে।
একদিন যায়। দু-দিন যায়।
দীর্ঘ টেণ্ডার টাইপ করতে করতে অমিয়র কাঁধ ব্যাথা করে। চোখে ঝাপসা দেখে। সিগারেটে সিগারেটে জিভ বিস্বাদ। রাজেন চা এনে রেখে গেছে। খাওয়া হয়নি।
–বাগচী। কল্যাণ ডাকে।
-উঁ
–আপনার কি কিছু টাকার দরকার?
অমিয় হাসে।
-রাজেনের কাছে আমি আরও ছ-শো টাকা রেখে দিয়েছি। আমি থাকি বা না থাকি, যখন দরকার হয় নেবেন।
–অনেক ধার হয়ে গেল মুখার্জি।