অমিয় একটু হেসেছিল।
হাসি আজ কিছুতেই ট্যাক্সিতে উঠতে চায়নি। বলেছে–এত সুন্দর রাত আজ। বাতাস দিচ্ছে, চাঁদ উঠেছে, বন্ধ গাড়িতে বসে কেন যাব! আমাকে তোমার স্কুটারে নিয়ে চলো।
তাই এনেছে অমিয়। তার কোমর ধরে বসে এল হাসি। মেয়েদের দঙ্গলে মিশে গেছে এখন। উৎসবে হাসিকে চেনা যায় না।
রাস্তায় পার্ক করা শেষ দুটো মার্ক টু গাড়ির একটা ছেড়ে গেল সোনাদাকে নিয়ে। যাওয়ার সময়ে সোনাদা মুখ বাড়িয়ে বলল–অমিয় তোর সঙ্গে কথা আছে।
-কী কথা?
–সেই যে, মনে নেই কী বলেছিলি?
–কী সোনাদা?
–তুই বড়ো পাজি অমিয়, চিরকাল পাজি ছিলি।
–কেন?
–আমার বয়স হচ্ছে না রে? এই বয়সে মানুষ একটু গুছিয়ে বসতে চায়, এই বয়সেই তো সংসারের ভোগ সুখ, এই চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশে।
অমিয় চেঁচিয়ে হেসে বলেছে–ঠিকই তো।
তবে তুই কেন আমাকে স্টিমারঘাটের কথা বলতে গেলি?
–কেন, কী হয়েছে?
–অমিয়, তুই কী বলিস তুই জানিস না! তুই চিরকালের পাজি। জানিস না, ওটা বলতে নেই! অমিয়, তুই চলে আসার পর থেকেই আমার বড় অস্থির লাগে। রাতে ঘুম হয় না। সারাদিন যখন-তখন অন্যমনস্ক হয়ে যাই। কেবলই মনে পড়ে–স্টিমারঘাট–স্টিমারঘাট।
শেষ মার্ক টু-টা দাঁড়িয়ে আছে। ওটা কার তা জানে না অমিয়। গাড়িটার আড়ালে তার স্কুটার হিম হয়ে আছে। হ্যাণ্ডেলটা একদিকে বাঁকানো। দেখে মনে হয়, ক্লান্ত মানুষ যেমন বসে বসে ঘুমোয় তেমনি ঘুমোচ্ছে।
পরিবেশনের সময়ে এঁটোকাঁটার গন্ধে গা গুলিয়েছে বলে কিছু খায়নি অমিয়। হাসি কখন আসবে কে জানে! রাত অনেক হয়েছে। পায়ে পায়ে প্যাণ্ডেল ছেড়ে খোলা মাঠে আসে অমিয়। ঠাণ্ডা দক্ষিণের বাতাস দিচ্ছে। সেই বাতাসে আকাশজোড়া এক বৃক্ষ নড়ে ওঠে, বকুলের মতো খসে পড়ে একটি তারা।
অন্ধকার বারান্দায় দুই বুড়ো বসে আছেন। বরের মামা, আর পিসেমশাই। বরের মামার দুগালে পানের ঢিবি। তিনি পিসেমশাইয়ের দিকে ঝুঁকে বলছেন–পুরুতরা আজকাল বড়ো শর্টকাট শিখেছে বিয়াই, আধ ঘণ্টায় কুসুমডিঙে সেরে ফেলল! আমার বিয়ের সময় চারঘণ্টা লেগেছিল যজ্ঞে। কনে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তাকে ঢুলতে দেকে আমি চিমটি কেটে জাগিয়ে দিই।
পিসেমশাই মুখ তুলে বলে–তুই কিছু খাসনি অমিয়?
-না। বমি-বমি করছে।
–খুব খেটেছিস। সোনাকে বলি তোকে একটু সরবৎ করে দিক।
-না, আমি এবার চলে যাই।
–অমিয়, লোকজন খেয়ে কী বলল? কিছু দোষ ধরেনি তো?
বরের মামা পিচ ফেলে বললেন–আজকালকার বাজারে যা করেছেন যথেষ্ট।
ঘরে মেয়েদের ভিড়। অমিয় দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে। হাসিকে দেখা যায় না।
সেই ভীড় থেকে সোমাদি এগিয়ে আসে–অমিয়, কী খাবি?
–কিছু না।
-আমি তো নেমন্তন্নের রান্না খেতে পারি না, তাই এ ঘরে একটু ঝোল-ভাত রেঁধে রেখেছি। খাবি তো আয় ভাগ করে খাই।
-হাসি কোথায় সোমাদি?
-ওকে তো সব ঘিরে রেখেছে। বলছে, তুমি ফাঁকি দিয়ে রেজিস্ট্রি বিয়ে করেছ, আমাদের খাওয়া মার গেছে। এবার খাওয়াও। অমিয়, হাসি দেখতে কী সুন্দর হয়েছে।
-রাত অনেক হয়ে গেল সোমাদি। হাসিকে ডাকো।
–তোর তো স্কুটার আছে, ভুস করে চলে যাবি। রাত হলে ভয় কী? তোকে একটু দই মিষ্টি এনে দিই?
সোমাদি, তুমি এত কষ্ট করো কেন?
–কীসের কষ্ট?
–খুব খাটো তুমি, টিফিনের পয়সা বাঁচাও, এত খেটে কী হবে সোমাদি?
–তোকে তো বলেছি, আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?
সোমাদি, একটা স্টিমারঘাট
–অমিয়, আমার এখনো অনেক কিছু করা বাকি, টাকা জমাচ্ছি, আমার অনেকদিনের শখ, একটা রেকর্ড-চেঞ্জার কিনব। রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের গানের অনেক রেকর্ড। শোন অমিয়, তুই নাকি রেখার বিয়ের জন্য মেসোমশাইকে এক হাজার টাকা দিয়েছিস। সত্যি?
–সোমাদি, তোমাকে সেদিন বলছিলাম
—-কী বলছিলি?
–একটা ফেরিঘাটের কথা
-অমিয়, মেসোমশাইকে এক হাজার টাকা দিয়ে খুব ভালো করেছিস। আমারও দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু কী করে দেব? জানিস তো, গত চোদ্দো-পনেরো বছর আমার চাকরির ওপরই সংসার চলছে। রেখাকে একটা আংটি দিলাম, তাতেই ধার হয়ে গেল। তুই টাকা দিয়ে ভালো করেছিস। মেসোমশাই সবাইকে ডেকে ডেকে তোর দেওয়া টাকার কথা বলছেন।
সোমাদি
–শোন অমিয়, এখন আর আমার চাকরি করতে ভালো লাগে না রে। তুই যে সেদিন গিয়ে বললি, ভালোবাসার লোক না থাকলে রোজগার করে সুখ নেই, সেটা বাজে কথা নয়। এখন আমি বুঝতে পারি সংসারে আমার যেটুকু আদর তা ওই চাকরিটার জন্য। এ চাকরিটা যদি ছাড়ি তবে দেখব আমি কিছু নই, কেউ নই। আজকাল তাই ভীষণ টায়ার্ড লাগে। বাসায় ফিরে রাত্রে এমন মন খারাপ লাগে! একটা ইজিচেয়ার কিনেছি, সামনের মাসে কিনব একটা রেকর্ড-চেঞ্জার। বুঝলি অমিয়, বারান্দায় অন্ধকারে বসব, উঠোনে থাকবে অন্ধকার, চুপচাপ বসে চেঞ্জার চালিয়ে দেব–গান হবে–দুঃখের গান–বিরহের গান–শুনতে শুনতে কাঁদব হয়তো–আর মনে পড়বে…কী মনে পড়বে রে অমিয়…?
অমিয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে–তুমি তো জান সোমাদি…
সোমাদি মাথা নেড়ে চাপা গলায় বলে–জানিই তো, জানব না কেন? মনে পড়বে..
পিসেমশাই সামনে এসে দাঁড়ান। কুজো দেখায় তাঁকে, বুড়ো দেখায়। অমিয়র দিকে অপলক একটু তাকিয়ে থেকে বলেন–আমি ভাবতাম ওর পিসিমা মরে গেছে বলেই বোধহয় অমিয় আর আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না, কিন্তু তা নয়। সোমা, অমিয় আমাকে