অমিয় স্থির চোখে নীপাকে চেয়ে দেখে। ঠিক। হাসি নীপার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী। হাসিও কালো। নীপার মতোই। তবু হাসির মুখ, চোখ, শরীরের গঠন অনেক উঁচু জাতের। নীপার হিংসে হতে পারে।
অমিয় মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বলে–আমরা কেউ কারো সম্পর্কে জানলাম না। কেন?
নীপা এ কথার উত্তর দিল না। কারণ, এ বড়ো বিপজ্জনক কথা। উত্তর হয় না।
অমিয় বলল–স্কুটার থাক, চলুন আপনাকে রাধাবাজারের দিকে একটু এগিয়ে দিই। পথে বরং এক কাপ চা খেয়ে নেব।
তারা হাঁটতে থাকে। নীপা মাথা নত রাখে। অমিয়কে সে যে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিচ্ছে সে বিষয়ে সচেতন। দূরত্ব বজায় রাখছে। বোধহয় ভয়ও পাচ্ছে মনে মনে। আবার বোধহয় চাইছেও, অমিয় তাকে কিছু বলুক।
–আজ এমন করছেন, কী হয়েছে আপনার? নীপা তার মস্ত চোখ তুলে হঠাৎ বলে।
আশপাশ দিয়ে কলকাতার দৃশ্যাবলি মিলিয়ে যাচ্ছে ডাইলিউশনে। রেলগাড়ির মতো দ্রুত বয়ে যাচ্ছে কলকাতা। সেই গতিশীলতার মধ্যে তারা ধীরে হাঁটে। অমিয় বলে–আমার ব্যাংক-এর অ্যাকাউন্ট কী বলছে।
নীপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে–ও!
আবার হাঁটতে থাকে তারা। ওল্ড কোর্টহাউস স্ট্রিট পার হতে হতে অমিয় বলে–আমি ভালো নেই নীপা।
নিজের নাম শুনে একটু চমকে ওঠে নীপা। চমকটা ঢাকা দিয়ে মৃদুস্বরে বলে–কেন? ব্যাংক-এর অ্যাকাউন্টের কথা ভেবে?
না। অমিয় বলে–আমি তোমাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু সে-কথা কখনো বলা হয়নি, এই অপরাধে।
নীপা ঠোঁট কামড়ায়, মাথা নত করে।
কলকাতার প্রকাশ্য রাজপথ। চারদিকে মানুষ আর মানুষের মধ্যে প্রবল গাড়ির আওয়াজের মধ্যে এক নিস্তব্ধতার ঘেরাটোপ নেমে আসে।
অমিয় হঠাৎ দাঁড়ায়। ভেতরে বিষবাষ্প জমে উঠেছে আজ।
নীপা তার দিকে মুখ তুলে তাকায়। দুটি চোখ বা’য়। কিছু বলতে চায়।
অমিয় আস্তে করে বলে–দেখা হবে। আবার।
–কোথায়?
অমিয় তেমনি আস্তে টরে-টক্কার মতো মৃদু লয়ে বলে–একটা স্টিমারঘাট আছে। সেইখানে সকলের দেখা হয়।
–কোথায়? নীপার কপালে ভাঁজ পড়ে।
–ধু-ধু গড়ানে বালিয়াড়ি বহুদূর নেমে গেছে। তারপর কালো গভীর জল। একটা ফাঁকা শূন্য জেটি। অথৈ জল। ওপরে একটা কালো আকাশ ঝুঁকে আছে। বালির ওপরে পড়ে আছে। একটা সাপের খোলস। হাহাকার করে বাতাস বয়ে যাচ্ছে সেখানে।
অবাক চোখে চেয়ে আছে মেয়েটা।
অমিয় বলে, দেখা হবে।
তারপর হেঁটে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল অমিয়।
নীপা খুব ধীরে ধীরে হাঁটে। ভাবে। মুখে কয়েকটা দুশ্চিন্তার রেখা খেলা করে যায়। তারপর কখন যেন চোখ ভরে জল আসে। জলভরা চোখে চেয়ে দেখে। কলকাতা শহরটা কেমন ভেঙেচুরে গেছে। আবছা, অষ্পষ্ট আর অলীক হয়ে গেল চারধার। অর্থহীন হয়ে গেল জীবন। বেলুনের মতো ফেটে গেল বাস্তবটা।
চোখের জল মুছে নেয় নীপা। ভুল রাস্তায় চলে যাচ্ছিল। সতর্ক হয়ে ফিরে এল সঠিক রাস্তায়। মানুষটা কেমন! খুব অদ্ভুত, না? ফের জল আসে চোখে। ওর অ্যাকাউন্টে মোটে দু শো পঁয়ত্রিশ টাকা আছে, নীপা জানে।
৪. স্বামীর দোকানের দিকে
স্বামীর দোকানের দিকে হাঁটতে থাকে নীপা। কলকাতা শহর চারদিকে, তবু কেবলই মনে হয়, বালিয়াড়ির ভেতরে ডুবে যাচ্ছে পা। সামনে জল। জলের শব্দ। কেউ কোথাও নেই, কেবল বাতাস ঝড়ের মতো বয়ে যায়। মাথার ওপর কালো আকাশ ঝুঁকে আছে।
টাপে টোপে প্যাণ্ডেলের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে উঁকি দেয় কুকুরের মুখ। তারা আসছে সতর্ক পায়ে। ক্রমে ক্রমে। বেড়ালেরা আসছে নিঃশব্দে, ভিখিরিরা বাইরের গাছতলায় অনেকক্ষণ বসে আছে। একটা ভিখিরির ছেলে ঢুকে গেছে প্যাণ্ডেলে। কুকুর-বেড়ালের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে পাতার ঠোঙায় কুড়িয়ে নিচ্ছে এঁটোকাঁটা। মাংসের হাড়, লুচির টুকরো, মাছের কাঁটা জড়ো করছে এক জায়গায়। খাঁ-খাঁ করছে প্যাণ্ডেল। স্টিক লাইট জ্বলছে, ঘুরছে পাখা, এঁটো পাতা উড়ে উড়ে গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। উৎসব-শেষের বীভৎসতা চারদিকে।
বর-বউ শোওয়ার ঘরে চলে গেল। নিয়ম নয়, কিন্তু আজকাল তো কেউ আর বাসর জাগে না। প্যাণ্ডেলের এক কোণে এখনও যজ্ঞের ছাই পড়ে আছে, দুটো রং করা বিচিত্র পিঁড়ি এখনও তোলা হয়নি, দেবদারু পাতায় সাজানো দরজায় মঙ্গল কলস, রঙিন কাগজের শিকল দুলছে হাওয়ায়।
একটা সিগারেট ধরিয়ে অমিয় দৃশ্যটা দেখে। সে এরকম ভাবে বিয়ে করেনি। কয়েকটা সই করে তারা বিছানায় চলে গিয়েছিল।
পিসেমশাইয়ের হাতে একহাজার টাকা দেওয়া গেছে অবশেষে। গতকাল সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছে অমিয়। টাকা-টাকা করে। প্যাটারসনের লাহিড়ি শুনে বলল–দূর মশাই, কে-বি ফিট করুন না।
-কে বি কী?
–কাবলে। আপনার যদি জানাশুনো না থাকে আমি ফিট করে দিচ্ছি। কিন্তু সাবধানে ট্যাকল করবেন। এক হাজার ধার নিলে দু হাজার লিখে দিতে হবে।
–সে কী?
-ভয় নেই। আসলে ওরা লাইসেন্স-ওলা মানি লেণ্ডার, গভর্নমেন্টের বেঁধে দেওয়া সুদের বেশি আইনত নিতে পারে না। আপনাকে লেখাবে ছয় পারসেন্ট সুদ, নেবে তার দ্বিগুণের বেশি। যদি বাইচান্স আপনি সুদ নিয়ে ঝামেলা করেন, তখন মামলা করবে দু হাজার টাকার ওপর। আর যদি সুদ ঠিকমতো দিয়ে এক হাজার শোধ দেন তাহলে কাগজ ছিঁড়ে ফেলবে। কিন্তু সাবধানে ট্যাকল করবেন।
আজ সকালে টাকা পেয়ে গেছে অমিয়। এক হাজার। পিসেমশাইকে কথামতো দেওয়া গেল। রেখার বর ভালোই হল। টাটার ইঞ্জিনিয়ার। দু হাজার নগদ, গোদরেজের আলমারি, সিঙ্গল খাট দুটো, সোফাসেট, পনেরো ভরি গয়না। পিসেমশাইয়ের বোধহয় আকাশ-বাতাস চাঁদ-সূর্যের আলো ছাড়া আর কিছু রইল না। অমিয়র জন্য সারাদিন হা-পিত্যেশ করে বসে ছিলেন বুড়ো মানুষ। অমিয় এসে টাকাটা হাতে দিতেই উদ্ভাসিত হয়ে গেল মুখখানা। চোখের কোলে জল। বললেন–ভাবলাম তুই বুঝি আর এলি না! ভয়ে তোর অফিসে ফোন করিনি, যদি খারাপ খবর শুনি!