ঘোলা ময়লা কাচের ভেতর দিয়ে কয়েক পলক চেয়ে থাকে অমিয়। নীপা টের পায়। মুখ তোলে।
অমিয় একটু হাসে। নীপাও একটু হাসে। ওর সিঁথিতে সিদূর। হাসিটা তেমনি সহৃদয়তায় ভরা। দেখে ভেতরে একরকম ছুঁচ ফোঁটার যন্ত্রণা হয়। ঘোলা ময়লা কাচের ভেতর দিয়ে প্রায়ান্ধকার করিডোরে দাঁড়ানো অমিয়কে চিনতে পেরেছে নীপা। চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে উঠে এল।
–কী খবর? আবার বুঝি জ্বালাতে এসেছেন? নীপা করিডোরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে।
অমিয় মাথা নাড়ল। বলল–না। কোনোদিন আপনাকে কাজ ছাড়া দেখি না। আজও দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।
কাজের জায়গায় দেখা হলে কাজ-ছাড়া কী করে দেখবেন?
অমিয়র এখন আর সাহসের অভাব হয় না। সে বলে–অকাজের জায়গায় কেমন দেখাবে কে জানে!
আশেপাশে ব্যস্তসমস্ত লোকেরা যাচ্ছে আসছে। নীপা বলে-বলুন না বাবা কী কাজ আছে। কোনো চেকের ক্লিয়ারেন্স আসেনি না কি!
-ওসব নয়। অ্যাকাউন্টে টাকাই নেই। চেক জমা দিই না অনেকদিন।
–সে তো জানি।
–কী করে জানলেন?
–আপনার অ্যাকাউন্টটা দেখি মাঝে মাঝে। আজকাল কেবল উইথড্রয়াল হচ্ছে, জমা পড়ে না। কী ব্যাপার?
অমিয় একটা শ্বাস ফেলে। মাথা নেড়ে বলে–আপনি আমাকে মনে রেখেছেন।
-মনে রাখব না! ব্যাংক-এর সব ক্লায়েন্টকে আমার মনে থাকে।
বানানো কথা। মিথ্যে।
অমিয় একটা বিষ বোলতার কামড় খায় এই কথায়। বলে–কোনো পক্ষপাত নেই, না?
নীপার মুখে একটু দুঃখের ছায়া খোঁজে অমিয়। পায় না। হাসিকে বিয়ে করার পর মাস দুই বাদে নীপার বিয়ে হয়। কেউ কাউকে নিমন্ত্রণ করেনি। জানায়ওনি। কিন্তু জানাবার দরকার হয় না। অমিয় তখন বিয়ের পর দেদার টাকা ওড়াত। হাসিকে স্কুটারের পেছনে বসিয়ে নিয়ে আসত ব্যাংক-এ। টাকা তুলত আর টোকেন নিয়ে অপেক্ষা করার সময়ে কলকলাত দু-জনে। সেসব কি দেখেনি নীপা? তেমনি আবার দু-মাস বাদে নীপার সিঁথিতে সিঁদূর দেখেছে অমিয়। কেউ কাউকে প্রশ্ন করেনি। জেনে গেছে।
নীপার মুখে তাই কোনো দুঃখের ছায়া নেই। কিন্তু তবু সে কেন অমিয়র অ্যাকাউন্টের খবর রাখে?
অমিয় বলে–আপনার টিফিনের সময় হয়নি?
হয়ে গেছে। কেন?
হতাশ অমিয় বলে–হয়ে গেছে! আমি ভাবছিলাম আজ আপনাকে খাওয়াব।
–তাই বা কেন! কোনো খাওয়া কি পাওনা হয়েছে! নীপা দাঁতে ঠোঁট কামড়ে হাসল। অমিয় মাথা নেড়ে বলল-খাওয়ার জন্য নয়।
-তাহলে?
অমিয় বুঝল, নীপার সঙ্গে আসলে তার কোনো বোঝাবুঝি তৈরি হয়নি। এমন অধিকার তার নেই যে সে ইংগিতে ডেকে নিয়ে যেতে পারে বিশ্বস্ত নীপাকে। এখন তার উচিত হবে ভদ্রতাসূচক দু একটা কথা বলে চলে যাওয়া।
কিন্তু চলে যেতে পারে না অমিয়। আস্তে করে বলে–আপনি মিস চক্রবর্তী ছিলেন, এখন কী হয়েছেন?
নীপা একটু তাকিয়ে থাকে তার দিকে। বোধ হয় মনে মনে বলে–আর যাই হই, বাগচী হইনি। তাকিয়ে থেকে নীপা মৃদুস্বরে বলে–আমার বুঝি কাজ নেই! কী দরকার বললেই তো হয়।
–আমার জানা দরকার, আপনি চক্রবর্তী ছেড়ে কী হয়েছেন।
নীপা মৃদু হাসল বটে, কিন্তু ভ্রূ কুঁচকে গেল একটু। বলল চক্রবর্তীদের অনেক গোত্র হয় জানেন তো! আমি চক্রবর্তী থেকে চক্রবর্তীই হয়েছি। গোত্রটা আলাদা। জেনে হবে কী!
-এমনি, কৌতূহল।
–আপনার চেহারাটা খারাপ হয়ে গেছে। আনঅফিসিয়াল কথাটা বলে ফেলেই বোধহয় লজ্জা পায় নীপা। মুখ ফিরিয়ে বলে–চলি।
অমিয় মাথা নাড়ল, তারপর করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে ধীরে ধীরে। দরজাটার কাছ বরাবর এসে ফিরে তাকায়। নীপা দাঁড়িয়ে আছে।
অন্য মেয়ে হলে এই অবস্থায় চোখে চোখ পড়তেই পালিয়ে যেত। নীপা পালাল না হাতটা তুলে তাকে থামতে ইংগীত করল। তারপর ঢুকে গেল ভেতরে।
অমিয় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। অপেক্ষা করে, একটু বাদেই নীপা আসে। হাতে ব্যাগ, ছোটো ছাতা, মুখখানায় একটু রক্তাভা। কাছে এসে বলে–আজ ছুটি নিয়ে এলাম। বাড়ি যাব।
অমিয় অবাক হয়। বলে–বাড়ি যাবেন?
–হ্যাঁ।
–তাহলে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখলেন যে!
নীপা উত্তর দিল না।
রাস্তায় এসে তারা ঝিরঝিরে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়ায়। অদূরে অমিয়র স্কুটার। অমিয় স্কুটারটা দেখিয়ে বলে–আজ আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি। যাবেন?
মুখ নীচু করে নীপা মাথা নেড়ে বলে–না। রাধাবাজারে আমার স্বামীর ঘড়ির দোকান আছে। কাছেই। এখন ওখানে যাব। সেখানে আমাদের গাড়ি আছে। তাতে ফিরব। এখন আমি নর্থ-এ থাকি। পাইকপাড়ায়।
–ও। অমিয় বুঝতে একটু সময় নেয়। নীপাকে ছাড়া নীপার আর কিছুই জানত না অমিয়। এখনও জানে না। শুধু ঘড়ির দোকান, স্বামী, গাড়ি আর পাইকপাড়া শব্দগুলো তার ভেতরে খুচরো পয়সার মতো হাত খসে পড়ে গিয়ে গড়াতে থাকে।
আপনি কী যেন বলতে চেয়েছিলেন। বললেন না।
অমিয় কষ্টে হাসে। ঘড়ির দোকানে স্বামী। স্বামীর গাড়ি। আর গাড়িতে পাইকপাড়া–এ সবই খুব রহস্যময় লাগে তার কাছে। নীপার কেন স্বামী থাকবে। সে কেন স্বামীর গাড়িতে পাইকপাড়া যাবে। কেন সে আজও অমিয়র নিজস্ব জিনিস নয়–তা ভেবে এক ধরনের ক্রোধ আর হতাশা মিশে যায় তার ভেতরে।
সে বলল-শুনুন।
-কী?
–আপনার সম্পর্কে কিছুই কোনোদিন জেনে নেওয়া হয়নি।
নীপা মৃদু হেসে বলে–জানাটা কী দরকার ছিল?
-আমার সম্পর্কেও আপনি কিছু জানেন না।
–না। তবে আপনার বউকে দেখেছি। খুব সুন্দর বউ।