অমিয়র সঙ্গে নীপার এমনিতে কোনো সম্পর্ক ছিল না।
চেক জমা দিয়ে টোকেন নেওয়ার সময়ে বা অ্যাকাউন্টের টাকার অঙ্ক জানতে এসে, মুখোমুখি একটু বেশিক্ষণ কি দাঁড়াত অমিয়?
চোখে চোখ পড়লে সহজে চোখ সরাত না বোধহয়? মাঝে মাঝে একটু-আধটু হাসত কি? সে যাই হোক, তাদের চেনাজানা ছিল খুব সহৃদয়তায় ভরা। অনুভূতিশীল। ব্যাঙ্ক আওয়ার্সের পরে এসে অমিয় বলত–একটু জ্বালাতে এলাম।
নীপা মৃদু অহংকারী হাসি হেসে বলেছে–কে না জ্বালায়! জ্বলে যাচ্ছি। দিন কী আছে…বলে হাত বাড়িয়ে চেক নিত।
রোগা মেয়ে পছন্দ করত অমিয়। মোটা বা বেশি স্বাস্থ্যবতী তার পছন্দের নয়। নীপা রোগা ছিল, আবার রুগ্নও নয়। বুকের স্নিগ্ধ ফল দু-টি মুখ তুলে চেয়ে থেকেছে পুরুষের দিকে। কনুই বা কব্জির হাড় তেকোণা হয়ে চামড়া ফুঁড়ে উঠে থাকত না। শরীরের চেয়ে অনেক আকর্ষক ছিল গলার স্বরে নম্রতা। অমিয় ছাড়া আর কাউকে কখনো নীপা ঠাট্টা করে কথার উত্তর দিয়েছে এমনটা অমিয় দেখেনি। খুব সিরিয়াসভাবে কাজ করত। মেয়েরা অফিসের কর্মচারি হিসেবে বেশির ভাগই ভালো হয় না। যেখানে তিন-চারটে মেয়ে জোটে সেখানে কাজ হওয়া আরও মুস্কিল! কিন্তু নীপা ছিল অন্যরকম। শনিবার যখন প্রচন্ড রাশ হয়, কিংবা কোনো ছুটির আগে যখন টাকা তোলার ধূম পড়ে যায় তখনো নীপাকে বরাবর নীচু গলায় লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে অমিয়, দেখেছে মুখে স্নিগ্ধ হাসি, অবিরল ব্যস্ততার মধ্যেও নানা লোকের অপ্রয়োজনীয় বোকা-প্রশ্নর উত্তর দিতে। একদিন দু-জন অল্পবয়সী ছোকরা স্রেফ ইয়ার্কি দিতে ব্যাংক-এ ঢুকে পড়েছিল। তারা উইথড্রয়াল স্লিপ নিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা লিখে জমা দিয়ে টোকেন নিল। ব্যাপারটা ধরতে দু মিনিটের বেশি লাগেনি নীপার। লেজার বইটা খুলে অ্যাকাউন্ট দেখে যখন তার উচিত ছিল দারোয়ান ডেকে ছোঁড়া দুটোকে বের করে দেওয়া, তখনও সে বিনীতভাবে তাদের ডেকে বলেছিল–সইয়ে যে নাম লিখেছেন তার সঙ্গে অ্যাকাউন্টের নাম মিলছে না। ছেলে দুটো সাহস পেয়ে আরও কিছু ইয়ার্কি দেয়, একজন বলে–তাহলে অ্যাকাডন্ট খুলব। ফর্ম দিন। নীপা আশ্চর্য, ধৈর্য ধরে রেখে ওদের ফর্মও দিয়েছিল যেটা ওরা কিছুক্ষণ কাটাকাটি করে ছিঁড়ে ফেলে চলে যায়। দৃশ্যটা অমিয়র চোখের সামনে ঘটে। নীপা স্বাভাবিক হাসি হেসে বলেছিল তাকে–এরকম প্রায়ই হয়। আমরা কিছু মনে করি না।
তখনো হাসির সঙ্গে দেখা হয়নি। এ হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক ঘটনা। তখন অমিয় মাঝে মাঝে নীপার কথা ভাবত বিরলে। মনেপড়া শুরু হয়েছিল, ভাবতে ভালো লাগত। ঘন ঘন তখন ব্যাংক-এ যাওয়ার দরকার পড়ত তার। রাজেন বা সেনগুপ্তকে পাঠালেও যখন কাজ চলে তখনও সে নিজেই যেত। নীপা যেদিন আসত না সেদিন ক্ষুণ্ণ হত সে। পরদিন এলে অনুযোগ করত–কাল আসেননি কেন? কাল আমার পেমেন্ট পেতে অনেক দেরি হয়েছে।
নীপা সে অনুযোগের সহৃদয় উত্তর দিত। বলত–রোজ তো আসি। এক-আধদিন না এলে বুঝি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়। যন্ত্র তো নই।
এ ধরনের কথা নীপা একমাত্র তার সঙ্গেই বলত এবং তখন চোখে চোখে মানুষের গভীর হৃদয় গোপন বার্তা পাঠাত না কি?
ব্যাংক-এর বাইরে দেখা হয়েছিল মোটে একদিন। গ্রান্ট স্ট্রিটের একটা দোকানে নীপা পুজোর জামাকাপড় কিনতে ঢুকেছিল। অফিসের পাড়া। অমিয় ডাব খাচ্ছিল পাশের পানের দোকানটায়। নীপা দেখেনি। অমিয় ভেতরে ঢুকে নীপাকে ধরল–এই যে!
নীপার সঙ্গে অফিসের আরও দুটি মেয়ে ছিল। তারা একটু ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে দেখল অমিয়কে। নীপারই ভ্রূ সহজ ছিল। মুখে হাসি ফুটল সেই সহৃদয়তার। অনেক কিছু এড়িয়ে যাওয়ার কথা বলতে পারত। কিন্তু খুব আন্তরিক লাজুক গলায় একটা ঘন নীল পাছা পেড়ে শাড়ি তুলে দেখিয়ে বলল–দেখুন তো, এটা অদিতিকে মানাবে না? অদিতি সঙ্গি মেয়েদের একজন। ফর্সা। অমিয় হেসে বলে–নীল শাড়ি সবাইকে মানায়।
যতক্ষণ শাড়ি কিনেছিল ওরা ততক্ষণ নীপা চোখের শাসনে আটকে রাখল অমিয়কে। অমিয় যতবার বলে–এবার যাই, কাজ আছে। ততবার নীপা বলে–দাঁড়ান। মেয়েরা ঠিক ঠিক শাড়ি পছন্দ করতে পারে না। পুরুষেরা অনেক পারে। আমাদের শাড়ি পছন্দ করা হয়ে গেলে যাবেন।
শাড়ি কেনা হলে সঙ্গিনীরা চলে গেল। বোধহয় একটা ষড়যন্ত্র করেই। নীপা একা হয়ে বলল–এবার আমাকে সাউথের বাসে তুলে দিন তো।
অমিয় তার স্কুটার দেখিয়ে বলে–বাসের দরকার কী! যদি সাহস থাকে তো উঠে পড়ুন। পৌঁছে দিয়ে আসি!
-ও বাবা! স্কুটার! পড়ে টড়ে যাব, কখনো চড়িনি।
অবশেষে উঠেছিল নীপা স্কুটারেই। মাঝপথে একটা রেস্টুরেন্টে চা খেয়ে নিয়েছিল তারা। অনেক কথাও হয়েছিল। এলোমেলো কথা। আর কথার মাঝখানে লজ্জার সঙ্কোচের এবং আকর্ষণের ঝাপটা এসে লাগছিল। মাঝে মাঝে কথা বন্ধ হয়ে যায়। নীরবতা নৈকট্যকে অদ্ভুত ভাবে টের পায় তারা।
শেষ পর্যন্ত কিছুই বলা হয়নি। টালিগঞ্জের খাল পাড় পর্যন্ত নীপাকে পৌঁছে দিল অমিয়। তারপর সিগারেট জ্বেলে থেমে থাকা স্কুটারে বসে দেখল নীপা নড়বড়ে সাঁকো পেরিয়ে ওপারে চলে যাচ্ছে। যাওয়ার সময়ে অনেকবার পিছু ফিরে চেয়ে দেখল তাকে। মুখটায় স্মিত গভীর একটা বিশ্বস্ততা।
না, কিছু হয়নি শেষ পর্যন্ত। হয়তো হতে পারত। মাঝপথে হাসি এসে সব তছনছ করে দিল। তুলে নিল তাকে। নিল, আবার নিলও না। বড়োঘরের মেয়েরা যেমন নিত্যনূতন জিনিস কিনে সেসব জিনিসের কথা ভুলে যায় দু-দিন পর। অবহেলায় ফেলে রেখে দেয়। তেমনি অমিয়কে কবে ভুলে গেছে হাসি।