–ঠিক আছে, আমি হাজার খানেক দেব।
–দিতে তোর কষ্ট হবে না তো?
–কষ্ট কী পিসেমশাই? রেখার বিয়েতে আমার তো দেওয়ার কথাই ছিল।
পিসেমশাই হাসলেন ফোনে। বললেন–কথা দিয়েছিস বলেই আবার কষ্ট করে দিস না।
অমিয় একটু আহত হল। সে দিতে পারবে না–এমন যদি কেউ ধরে নেয় তবে তার আহত হওয়ারই কথা।
সে একটু নীচু স্বরে বলল–পিসিমা বেঁচে থাকতে, সেই কবে ছেলেবেলায় আমি পিসিমাকে প্রায় সময়েই বলতাম, রেখার বিয়ে আমি দেব, সে-কথা তো রাখতে পারলাম না পিসেমশাই।
পিসিমার উল্লেখে পিসেমশাই নীরব হয়ে গেলেন। অনেকটা পরে যখন কথা বললেন তখন টেলিফোনেও বোঝা গেল, গলাটা ধরে গেছে।
বললেন–তা হোক, ছেলেবেলায় মানুষ কত কী বলে। যা দিতে পারিস দিস।
–আচ্ছা পিসেমশাই।
-শোন, বউমাকে বিয়ের দু-একদিন আগে আমাদের এখানে পাঠাতে পারবি না? বিয়ের কাজকর্ম মেয়েছেলে ছাড়া কে বুঝবে!
হাসিকে বললে হাসি রাজি হবে কিনা তা কে জানে। তাই অমিয় উত্তরটা ঘুরিয়ে দিল– সেদিন যখন গিয়েছিলেন তখন নিজেই তো বউমাকে বলে আসতে পারতেন।
-লজ্জা করল। বউমা তো আমাকে খুব ভালো চেনেন না, দু-এক বার মাত্র দেখেছেন, তুইও সাহেবি কায়দায় বিয়ে করলি, সামাজিক অনুষ্ঠান হল না!
অমিয় লজ্জা পায়। বলে-তাতে কী?
–সামাজিক বিয়ে হলে সেই অনুষ্ঠানে সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে নতুন বউয়ের চেনাচিনি হয়ে যায়। তোর বেলায় তো সেরকম হয়নি, তাই একটু দূরের মানুষ হয়ে আছি আমরা। তবে তোকে বলি অমিয়, বউমা ভারি ভালো হয়েছে। পরিচয় দিতে কত যত্ন-আত্তি করল। আজকালকার মেয়েদের মতো নয়।
অমিয় উত্তর দিল না।
–অমিয়।
–বলুন পিসেমশাই।
–পারিস তো বিয়ের আগে হাসিকে পাঠিয়ে দিস।
–দেখি।
–দেখি-টেখি নয়, এয়োর কাজ করার লোক নেই।
-আচ্ছা।
ছাড়ছি, বলে পিসেমশাই ফোন রাখলেন।
ফোনটা রেখে অমিয় তিন বুড়োর দিকে তাকাল, তিনজনই পাথর হয়ে বসে আছে। একেই কি স্থবিরতা বলে! তান্ত্রিক লোকটা একবার চোখ তুলে অমিয়র দিকে তাকায়, মাথায় জটা, কপালে মস্ত লাল একটা ফোঁটা, চোখ দুটোয় বেশ তীব্র চাউনি। হেসে এবং তাকিয়ে হঠাৎ শ্বাস ছেড়ে বলল–টাকা!
অমিয় হাসে। উলটো দিকের দুই বুড়ো খুব আগ্রহের সঙ্গে তান্ত্রিকের দিকে ঝুঁকে বসল, বাবা যদি এবার কিছু বাণী দেন।
অমিয় মাথা নেড়ে বলল–টাকা।
তান্ত্রিক তার দুই ভক্তের দিকে চেয়ে আস্তে করে বললে–টাকা।
ভক্ত দু-জন কী বুঝল কে জানে। জুল জুল করে চেয়ে থাকে।
অফিসঘরে এসে অমিয় ফাঁকা ঘরটার চারদিকে চাইল। কেউ নেই। কাগজপত্র হাওয়ায় নড়ে শব্দ করছে। পুরোনো ফ্যান থেকে একটা ঘট ঘটাং শব্দ উঠছে।
কিছুক্ষণ বসে থাকল অমিয়। রেখার বিয়ে, এক হাজার টাকা দিতে হবে।
অমিয় বেরিয়ে এল।
স্কুটারটা এখনও তার আছে। বেশিদিন থাকবে না। কল্যাণকে সে দিয়ে দিয়েছে, যতদিন ও না নেয় ততদিন তার। আহমদ একটা মফস্সলের লোককে জাঙিয়া গছানোর চেষ্টা করছে। অমিয়কে দেখে নীচু গলায় বলল–সাহা ব্রাদার্স থেকে লোক এসেছিল তাগাদায়, হটিয়ে দিয়েছি। আবার তিনটের পর আসবে।
অমিয় উত্তর না দিয়ে গিয়ে স্কুটার চালু করে।
যে ব্যাংকে অমিয়র অ্যাকাউন্ট আছে তা অনেকটা তার ঘরবাড়ির মতো হয়ে গেছে, বহুকাল ধরে একই ব্যাংক-এ সে টাকা রাখছে, তুলছে, চেক বা ড্রাফট ভাঙাচ্ছে। সবাই মুখ চেনা হয়ে গেছে। কেউ কেউ একটু বেশি চেনা এবং একজনের সঙ্গে পরিচয় আরও একটু গভীর।
ব্যাংকের বাইরে স্কুটার রেখে অমিয় ভেতরে আসে! সোনাদার ব্যাংক যেমন বড়ো, আর হালফ্যাশানের এই ব্যাংকটা তেমন নয়। প্রাইভেট আমল থেকেই এর মলিন দশা, কাউন্টারের পুরোনো কাঠে গাঢ় খয়েরি রং ধরেছে, দেয়ালের রং বিবর্ণ, কাঠের পার্টিশনগুলো নড়বড় করে।
কারেন্ট অ্যাকাউন্টটা অমিয় বহুদিন হল বন্ধ করে দিয়েছে! সেভিংসে কিছু টাকা থাকা সম্ভব, পাশবইটা বহুকাল এন্ট্রি করানো হয়নি। কত টাকা আছে কে জানে!
টোকেন ইসু করার কাউন্টারে একসময়ে নীপা চক্রবর্তী বসত। ভেতরের দিককার একটা ঘরে বসে আপন মনে কাজ করে। পাবলিকের সামনে আর থাকে না।
কাউন্টারের মেয়েটি ফোর ওয়ান নাইন নাইন অ্যাকাউন্ট লেজার খুলে দেখে বলল–না, হাজার টাকা তো নেই। দু-শো পঁয়ত্রিশ টাকা আছে।
অমিয় যন্ত্রের মতো শব্দ করে–ও।
আরও দুটো ব্যাংক-এ অ্যাকাউন্ট আছে অমিয়র। কিন্তু সেখানে আর যাওয়ার আগ্রহ হয় না। খুব বেশি নেই। যা আছে তাতে হাত দেওয়া যায় না। হাসি চলে যাবে। অনেক পেমেন্ট বাকি। একটা হতাশা ভর করে তাকে। মুখটা বিস্বাদ। খালি পেটে সম্ভবত পিত্ত পড়েছে। মাথার মধ্যে একটা রিমঝিম। চোখের সামনে একটু অন্ধকার, অন্ধকারে উজ্জ্বল কয়েকটি তারা খেলা করে মিলিয়ে গেল। দুর্বলতা থেকে এরকম হয়।
দুটো বাজতে আর খুব বেশি দেরি নেই। বেলা দুটোয় সব জায়গায় টাকা পয়সার ওপর ঝাঁপ পড়ে যায়।
ভেতরের দিকে একটা করিডোর গেছে। ওদিকে একটা বাইরে যাওয়ার দরজা আছে। ব্যাংক-এর সামনের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে ওদিক দিয়ে যাতায়াত করে লোক। ব্যাংক আওয়ারের পরে এসেও বহুদিন ওই দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেছে অমিয়, চেক ক্যাশ করে নিয়ে গেছে। নীপা চক্রবর্তী ওইটুকু ভালোবাসা দেখাত।
দু-শো পঁয়ত্রিশ টাকায় হাত দিল না অমিয়। থাকগে। সে করিডোর ধরে ভেতরের পার্টিশানের কাছে এসে দাঁড়ায়। কাঠের পার্টিশনে কাচ লাগিয়ে বাহার করার চেষ্টা হয়েছে। ময়লা ঘোলা কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যায় লম্বা লম্বা টেবিলের ওপর ঝুঁকে কয়েকজন কাজ করছে। তৃতীয় জন নীপা। শ্যামলা রং রোগা শরীরে ইদানিং একটু মাংস লেগেছে। মুখখানা নোয়ানো বলে ভালো দেখা যায় না। কিন্তু অমিয় জানে মুখখানা ভালোই নীপার। টসটসে মুখ বলতে যা বোঝায় তাই। বড়ো বড়ো দুখানা চোখ ভরে একটা নরম সৌন্দর্য ছড়িয়ে থাকে। চোখে কাজল দেয় নীপা, কপালে টিপ পরে, সাদা খোলের শাড়ি পরে বেশিরভাগ সময়ে। রঙিন পরলে হালকারঙা। গায়ের রং চাপা বলে চড়া সাজ কখনো করে না। তাতে ও ফুটে ওঠে বেশি।