-শুনছি। বলো।
–সে এই কথা লিখেছিল। আরও লিখেছিল, তাদের কালাশৌচের মধ্যেই যে তারা আমাকে আশীর্বাদ করে রেখেছিল, সেটাও তারই আগ্রহে। তার ভয় ছিল, আশীর্বাদ করে না রাখলে ওই সময়ের মধ্যে আর কেউ এসে আমাকে বিয়ে করে ফেলবে। তখন শিলচরে আমার স্যুটার অনেক, ঝাঁকে ঝাঁকে চিঠি পেতুম…শুনছেন?
–শুনছি।
-কালো হলেও তো আমি সুন্দরী-ই। তার ওপর দারুণ নাচতাম, গাইতাম। আমার পায়ে পুরুষদের মাথা নূপুরের মতো বাজত।
ও-পাশে জামাইবাবু বহুক্ষণ শ্বাস ধরে রেখে আবার অনেকক্ষণ ধরে শ্বাস ছাড়ে। হাসি হাসে।
–কিছু বুঝলেন জামাইবাবু?
–বুঝলাম।
–কী?
তুমি আর ফিরবে না হাসি।
ও-পাশে জামাইবাবু একটুক্ষণ চুপ করে থাকে। হাসি অপেক্ষা করে।
–হাসি, স্টিমারঘাটটা সাবধানে পার হোয়ো। ও জায়গাটা ডেঞ্জারাস।
হাসি চমকে উঠে বলে।– স্টিমারঘাট! কোন স্টিমারঘাট?
–বা:, ফারাক্কায় তোমাকে ঘাট পেরোতে হবে না?
–ওঃ। বলে স্তব্ধ হয়ে থাকে হাসি।
–একা যাচ্ছ, আমরা চিন্তায় থাকব। ওপারে বঙ্গাইগাঁও এক্সপ্রেসে তোমার রিজার্ভেশন আছে, ভুল করে দার্জিলিং মেলে উঠো না।
–ভুল ট্রেনে ওঠাই কি আমার স্বভাব জামাইবাবু?
জামাইবাবু একটু চুপ করে থেকে বলে–ভুল ট্রেনের কথা বলছ হাসি! কিছু ইঙ্গিত করছ কি? তবে বলি, আমাদের আমলে ভুল ট্রেনে উঠলেও শেষ পর্যন্ত যেতে হত। হয়তো ভুল জায়গায় গিয়ে পৌঁছোতাম। কিন্তু তবু যেতে হত। তোমাদের আমল আলাদা। তোমরা ভুল ট্রেন বুঝতে পারলেই চেন টেনে নেমে পড়তে পার।
-আমরা ভাগ্যবান।
–দেখা যাক। আমি আরও কিছু দিন বাঁচব হাসি।
হাসি হাসে।
–এখনও সাত-আট দিন সময় আছে, এ ক-দিন কী করবে হাসি?
–কী করব! ঘুরব, ঘুরে বেড়াব।
–কোথায় যাবে?
–কোথাও না। কলকাতা–কেবল কলকাতায় ঘুরব–ইচ্ছেমতো।
কলকাতায় আর কোথায় ঘুরবে, কী আছে কলকাতায়?
–কী আছে? কী জানি! আমি তো বিশেষ কোথাও যাব না। আমি ঘুরে বেড়াব রাস্তায় রাস্তায়। রঙিন দোকান দেখব, আলো দেখব, পার্কে বসে থাকব, কলকাতা পুরোনো হয় না।
-কলকাতায় তুমি কী পেয়েছ হাসি?
কী পেয়েছি! হাসি তা ভেবে পায় না। সে চোখ বুজে থাকে মনে মনে বলে–কলকাতা। কলকাতা আমার প্রেমিক। জ্বলন্ত এক পুরুষ কলকাতা। সে আমাকে সব সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করে টেনে এনেছিল, সুখি হতে দেয়নি। সে আমাকে নিয়ে আরও কত খেলা খেলবে, তোমরা দেখো।
–হাসি, ফোন কী ছেড়ে দিয়েছ?
–না তো।
-তোমার শ্বাস-প্রশ্বাসও যে শোনা যাচ্ছে না।
-শুনছি। বলুন।
–এ কয়দিন অমিয়কে সঙ্গে নিয়ে ঘুরো।
-ও-মা! ওকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরব না কেন? এইতো ওর পিসতুতো বোনের বিয়েতে যাচ্ছি একসঙ্গে। ওর স্কুটারে বহুদিন চড়িনি। ভাবছি ওর স্কুটারের পিছনে বসে একদিন ঘুরে বেড়াব। অফিসপাড়া, কলেজ স্ট্রিট, পার্কস্ট্রিটের রেস্টুরেন্ট দেখে বেড়াব দু-জনে। জামাইবাবু আপনি কী ভাবছেন আমার প্রেজুডিস আছে? একদম নেই। আমরা দুজনে কথা বলি, হাসি ঠাট্টা করি, কখনো ঝগড়া করি না। এমনকী মাঝে মাঝে এক বিছানায়…জামাইবাবু শুনছেন?
–কী ভয়ঙ্কর।
–কী?
–তোমার নিষ্ঠুরতা।
মাথা আস্তে আস্তে পেছনে হেলিয়ে দিচ্ছিল হাসি। ক্রমে পিঠ বেঁকে গেল পিছনে, মাথা প্রায় স্পর্শ করল পিঠ। কত উঁচু বাড়ি। উঠে গেছে তো উঠেই গেছে। কী বিশাল বাড়িটার বুক, কী পাথুরে গড়ন! দেখতে দেখতে নেশা ধরে যায়। হ্যারিংটন স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে বাড়িটার ঠিক পায়ের তলা থেকে চূড়া দেখার চেষ্টা করল হাসি, তার মুখে ঘাম জমে গেল বেদনায়।
–বাব্বাঃ! আপনমনে বলল সে। হেসে আঁচলে একবার মুখ মুছে নিল। কলকাতার প্রোথিত ইমারত চারদিকে, তার মাঝখানে নিজেকে ধূলিকণার মতো লাগে তার। কান পাতলে –পাতালের খরস্রোতা নদীর গর্জনের মতো উতরোল কলকাতার গম্ভীর শব্দ শোনা যায়। কী রোমাঞ্চ জাগে শরীরে! কলকাতা–তার চারদিকে উষ্ণ কল্লোলিত কলকাতা!
হাসি পায়ে পায়ে পার হয় রাস্তা। ময়দানের দিকে ট্রামলাইন পেরোলে দেখা যায় সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এলোমেলো পড়ে আছে–যেন বা যে খুশি নিয়ে যেতে পারে। ঘনপত্র গাছের ছায়া। পাতা ঝরে পড়ছে। পাখিরা ফেলে দিচ্ছে কুটোকাটা। নিবিড় ছায়া এখানে। পায়ের নীচে ঘাস, পাতা, নির্জনতা। হাসি পায়ে পায়ে উদ্দেশ্যহীন হাঁটে। কিছুই দেখে না, অথচ সব কিছু অনুভব করে তার সর্বগ্রাসী মন।
সামনেই একটা কালো হেরাল্ড গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। নতুন চকচকে গাড়ি। গাড়ির বনেটে হাত রেখে একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে। ফর্সা, মজবুত চেহারা, লম্বা জুলপি, ঘন বড়ো চুল, চৌকো মুখ। রঙিন চৌখুপওলা শার্ট তার পরনে, আর জলপাই-রঙা সরু চাপা প্যান্ট, পায়ে চোখা জুতো, কোমরের চওড়া বেল্টের বকলসে একটা ইস্পাত রঙের ইংরিজি ডি অক্ষর ঝলসে ওঠে। কবজির ঘড়িতে মোটা সোনারঙের চেন। মানুষটা হাসিকে দূর থেকেই লক্ষ করে। অন্যমনে একটা ঘাসের ডাঁটি তুলে আলস্যভরে চিবোয়। হাসি এগিয়ে যায় ধীরে ধীরে। সেই হাঁটা দেখে লোকটা দেখে তার পোশাক, মুখশ্রী, তার বুক, চোখ। চোখই বেশি লক্ষ করে। চেয়ে থাকে। একটা লক্ষণ খুঁজে দেখে। বোধহয় লক্ষণটা মিলে যায়। মিলিয়ে লোকটা হাসে। একটু বড়ো এবং মসৃণ দাঁত তার। ধারালো। হাসির একটুও ভয় করে না। সে এগোতে থাকে। লোকটা হাসে। হাসি এগোয়। হেরাল্ড গাড়িটার গায়ের পালিশে হাসির ছায়া পড়ে। লোকটা বনেট থেকে হাতের ভর তুলে নেয়। ঝুলে পড়া শার্ট, কোমরে গুঁজে এক পা এগিয়ে আসে। আর এক পা। আর এক পা এগুলেই হাসির পথ আটকাতে পারে, ছুঁয়ে ফেলতে পারে হাসিকে। ডাক দেয়–মিস-ও মিস