ও-ঘর থেকে একটা চৌকো আলো এসে এ ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকে অনেকক্ষণ। অমিয়র রাত্রে ভালো ঘুম হয় না।–হাসি জানে। অনেক রাত জেগে ও বই পড়ে। সিগারেট ধরানোর শব্দ হয় রাতে, পায়চারীর শব্দ হয়, কাশির।
চৌকো আলোটাতে একটা মানুষের ছায়া পড়ে। বাঁকা ছায়াটা, একটা কাঁধ উঁচু দেখায়, মাথাটা বেঁকে পড়ে আছে।
হাসি চেয়ে থাকে।
দরজার কাছ থেকে অমিয় বলে–কেউ এসেছিল?
হাসি মৃদুগলায় বলে–টেলিফোনের লোক। কাল তোমার টেলিফোন দিয়ে যাবে।
টেলিফোন! একটু অবাক হয় অমিয়।
-বলল, তুমি তিনবছর আগে অ্যাপ্লাই করেছিলে, এতদিনে মঞ্জুর হয়েছে।
–টেলিফোন দিয়ে আমি এখন কী করব?
হাসি একটু হাসে। বলে–লোকের সঙ্গে কথা বলবে। কত কথা আছে মানুষের, শোনার লোকেরও অভাব নেই।
–আমার কোনো কথা নেই।
–কে বলল নেই! শুনতে পাই, তুমি লোককে একটা স্টিমারঘাটের কথা বল।
–সে-কথা থাক হাসি। আর কে এসেছিল?
–এক বুড়োমতো ভদ্রলোক; তোমার পিসেমশাই। তাঁর মেয়ের বিয়ের চিঠি রেখে গেছেন।
–চিঠি দেখেছি। তিনি কিছু বলেননি?
-বলেছেন। পরশু বিয়ে, আমি যেন অবশ্যই তোমাকে নিয়ে বিয়েতে যাই। অনেক বার বললেন। আমি বলেছি–যাব। চা করে খাইয়েছি। অনেকক্ষণ বসেছিলেন তোমার জন্য।
-আর কিছু বলেননি?
–না। বোধ হয় কিছু বলার ছিল, তোমাকে বলতেন। আমাকে কিছু বলেননি।
-বলেছিলাম, রেখার বিয়েতে এক হাজার টাকা দেব। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে ভাবিনি।
–দেবে যখন বলেছিলে তখন তো দেওয়াই উচিত। তাঁর পোশাক দেখেই মনে হয় অবস্থা ভালো না।
–কোথা থেকে দেব?
-তুমি আমাকে যেসব গয়না দিয়েছিলে সব স্টিলের আলমারিতে আছে। দরকার হলে নিতে পার, আমি তো নিচ্ছি না।
–আমাদের বংশের কেউ কখনো ঘরের জিনিস বেচেনি।
–তা হলে কী করবে?
–বুঝতে পারছি না।
হাসি লক্ষ করে একটা ধুতি জড়িয়ে অমিয় দাঁড়িয়ে আছে। কোমরের ওপর ওর খালি গা। পেছন থেকে আলো এসে পড়েছে ওর গায়ে। মাথাটা বোধহয় ভেজা, পাটকরা চুল থেকে আলো পিছলে আসছে। লম্বাটে হাড়সার দেহ অমিয়র। অমিয় রোগা হয়ে গেছে কিনা তা ঠিক বুঝতে পারে না হাসি। এসব বোঝা খুব মুশকিল। ওই দেহটির স্বাদ সে বহুবার পেয়েছে। তার দুই হাতে, নগ্ন শরীরের আনাচে-কানাচে আজও ছড়িয়ে আছে সেই স্বাদ। কতবার সে বেষ্টন করেছে ওই শরীর, মথিত হয়েছে। তবু ওই শরীরের সব খবর তার জানা নেই।
অমিয়র ঠোঁটে একটা সিগারেট একটু জ্বলে উঠল। সেই আগুনটাই বোধহয় একটা আশ্লেষ তৈরি করে হাসির শরীরে। সে শরীরের ভঙ্গি বদলায়। হঠাৎ প্রশ্ন করে–তোমার ওজন কত?
অমিয় একটু থমকে থাকে। প্রশ্নটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে–কী বলছ?
–তোমার ওজন কত?
–কেন?
–এমনিই জিজ্ঞেস করছি। জামাইবাবু বলছিল, তুমি নাকি রোগা হয়ে গেছ। তোমার কি ওজন কমে গেছে?
–কী জানি।
–তুমি ওজন নাও না?
–না।
হাসি একটু শ্বাস ফেলে বলে–আমার রিজার্ভেশন পাওয়া যায়নি। কলকাতায় আমাকে আরও কয়েকদিন থাকতে হবে।
-থাকবে। তাতে কী?
–আমি দিদি-জামাইবাবুর কাছে চলে যেতে পারতাম এ ক-দিনের জন্য। কিন্তু সেখানে পাশের ফ্ল্যাটে তোমার দিদি-জামাইবাবু থাকেন। গেলে ওঁরা নানারকম সন্দেহ করতে পারেন বলে যাইনি।
–যেমন তোমার ইচ্ছে।
–খুশির বিয়ের তারিখ এসে গেল! রিজার্ভেশন পাওয়া যাচ্ছে না। কী যে করব!
–প্লেনে চলে যাও।
–তুমি ভাড়া দেবে? অনেক ভাড়া কিন্তু।
–দেব।
–তুমি আমাকে অনেক দিয়েছ।
–প্লেনের ভাড়া কত?
–দু-তিন-শো হবে বোধহয়। আমি ঠিক জানি না। তোমার ব্যবসার অবস্থা কী?
-ভালো নয়।
খুব খারাপ?
—হুঁ।
–কীরকম খারাপ?
–উঠে যাওয়ার মতো।
–কেন?
–হাসি, আমি প্লেনের ভাড়া ঠিক দেব।
–হাসির ঘুম পায়। সে হাই তুলে বলে-দরজার পর্দাটা টেনে দেবে? চোখে আলো লাগছে।
পরদিন দুপুর বেলা জামাইবাবুকে ফোন করে হাসি।
–জামাইবাবু, রিজার্ভেশন যদি না পাওয়া যায় তো আমি প্লেনে যাব।
–তার দরকার নেই, তেরো তারিখের একটা স্লিপার বার্থ পাওয়া গেছে।
পাওয়া গেছে? সত্যি?
–সত্যি। সুখের পাখি এবার উড়ে যাও।
হাসি চুপ করে থাকে।
–ফোন কি ছেড়ে দিয়েছ হাসি?
না।
–কাল ছেড়ে দিয়েছিলে। একটা প্রশ্নের জবাব দাওনি।
-জামাইবাবু, আমাদের মধ্যে কোনো ঝগড়াঝাঁটি হয়নি। কথাবার্তা বন্ধ হয়নি। কাল রাতেও অনেকক্ষণ আড্ডা মেরেছি। আমরা সম্পূর্ণ নরমাল। এমনকী কোর্ট-কাছারির কথাও ভাবছি না।
–তবে কি ফিরে আসার কথাও ভাবছ?
-না।
–তুমি কোথা থেকে ফোন করছ হাসি?
—কেন?
–ফ্রিলি কথা বলতে পারবে?
–আমি বাসা থেকে ফোন করছি।
–বাসা থেকে! বাসায় কবে ফোন এল?
–আজ। বছর তিনেক আগে অ্যাপ্লাই করেছিল, আজ কানেকশান দিয়ে গেছে।
–ফোন কেন নিতে গিয়েছিল অমিয়? দুপুরে অফিস থেকে তোমার সঙ্গে প্রেম করার জন্য?
—হবে হয়তো।
–ফোন কোম্পানির মতো বেরসিক দেখিনি। যখন পাখি উড়ে যাচ্ছে তখনই এল ফোন! এখন দুপুরে কার সঙ্গে কথা বলবে অমিয়? বেচারা!
-কী বলছিলেন বলুন।
–ডিগবয়ের তেল কোম্পানির সেই ইঞ্জিনিয়ার, যে এখনও বিয়ে করেনি শুনেছি। সত্যি? –
-সত্যি।
–সে কখনো তোমার সঙ্গে দেখা করেছিল হাসি?
হাসি একটু দ্বিধা করে বলে-না না।
–তবে কী করেছিল?
একটা দীর্ঘ চিঠি দিয়েছিল। তাতে বার বার একটা প্রশ্ন করেছিল–আমার কী দোষ? আমাদের অপরাধ কী? আপনি কেন এমন করলেন? আরও লিখেছিল, যদি কখনো নিজের ভুল বুঝতে পারি তবে যেন তাকে জানাই, সে সারাজীবন অপেক্ষা করবে, নিঃশর্তে গ্রহণ করবে আমাকে…জামাইবাবু আপনি কি শুনছেন? আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসও যে শোনা যাচ্ছে না।