অমিয় বলল–আচ্ছা।
রাস্তায় বেরিয়ে এসে আর হাসির কথা মনে থাকে না। দু-চারদিন বৃষ্টির পর গরম কমে গেছে। আকাশ গভীর নীল। বাতাস পরিষ্কার। স্কুটারটা মৃদু গোঙানির শব্দ করে ছুটছে। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে যত অপ্রীতিকর কথা ভুলিয়ে দিয়ে মাথা পরিষ্কার করে দেয়। পরতে পরতে খুলে যাচ্ছে কালো রাস্তা। কলকাতার একরকম সুন্দর গন্ধ আছে। বর্ষার পর রোদ উঠলে প্রায়ই গন্ধটা পায় সে। রাস্তার পর রাস্তা পার হয় অন্যমনে।
ত্রিশ নম্বর ধর্মতলায় তার অফিস। ফুটপাথ থেকেই সোজা কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে খাড়া। সিঁড়ির পাশেই ফুটপাথে একটা গেঞ্জি, ব্রেসিয়ার, রুমাল, আণ্ডারওয়্যারের স্টল চালায় আহমদ। অমিয়র স্কুটারটা সারাদিন সে-ই পাহারা দেয়। রুমালটা আণ্ডারওয়্যারটা আহমদের কাছ থেকেই নেয় অমিয়। বদলে আহমদ স্কুটারটা নজরে রাখে। দরকারে অল্প অল্প টাকা ধার দেয়। অমিয়র দু-চারজন পাওনাদারকেও সে চিনে রেখেছে। নীচের তলা থেকেই তাদের তাড়ায়, বলে–তিনতলার সিঁড়ি খামোখা ভাঙবেন কেন, একটু আগেই বেরিয়ে গেছেন।
সিঁড়িটা সত্যিই খাড়া। উঠতে জান বেরিয়ে যায়। সিঁড়ির আট ধাপে একটা ছোট্ট চাতাল। সেই চাতালটা আহমদের একটা সংসার। দুপুরে তার ভাত আসে, কাছেই কোনো স্কুলে পড়ে তার দুই ছেলে, টিফিনে তারাও এসে হাজির হয়। চাতালে বসে অন্ধকারে বাপ-ব্যাটারা ভাত খায়। গা ঘেঁষে লোকজন ওঠানামা করে, ধুলো ওড়ে, কাঠের সিঁড়ি কাঁপে, তবু তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই। চাতালের একদিকে আহমদের পোঁটলা-পুঁটলি, দেয়ালের পেরেকে ঝোলানো জামাকাপড়, জুতো।
তিনতলায় উঠতে আজ বেশ কষ্ট হল। অফিস বলতে যা বোঝায় তা তো নয়। ঘরটা বড়োই, তার তিন অংশীদার। আসলে ঘরটার মূল ভাড়াটে কল্যাণ। দশ-বারো বছর আগে এই ঘর ভাড়া নিয়ে তৃষ্ণা অ্যাণ্ড কোং খুলেছিল। আজও কোম্পানি আছে, কল্যাণও আছে। তফাতের মধ্যে এই যে, সেই ঘরে পাশাপাশি টেবিলে আরও দুটো কোম্পানি চালু হয়েছে। একটা রজতের, একটা অমিয়র। তারা দু-জন কল্যাণের সাবলেটের ভাড়াটে। একই ঘরে এ রকম চার-পাঁচটা কোম্পানিও চলে। একটা টেলিফোন আর একটা ঠিকানা থাকলেই কলকাতায় ব্যবসায় নামা যায়।
মিশ্রিলাল বসে আছে। একমাত্র মিশ্রিলালকেই আহমদ কখনো ঠেকাতে পারেনি। ধৈর্যশীল মিশ্রিলাল ঠিক তিনতলা পর্যন্ত উঠবেই, উঠে অমিয়কে না দেখলে বসে থাকে, বসে থাকতে থাকতে ঝিমোয়। বিকেল পর্যন্তও বসে থাকে সে। অমিয়কে দেখে মিশ্রি একবার চোখ তুলে নামিয়ে নিল। হাতে একটা টেণ্ডারের চিঠি।
রাজের গ্লাসে ঢেকে জল রেখে গেছে। টেবিলে কাগজপত্র প্রায় কিছুই নেই। দুটো চিঠি। টেণ্ডার চিঠি দুটো দেখে রেখে দিল সে। চেয়ার টেনে বসল। রাস্তার ওপারে গভর্নমেন্টের একটা স্টোর। লরি থেকে মাল খালাস করছে। রাস্তায় ট্রামের শব্দ হচ্ছে, বাস যাচ্ছে। কাচের পাল্লাটা বন্ধ করে দিয়ে শব্দ আটকাল অমিয়।
মিশ্রি বলল, কিছু দেবেন নাকি?
ও সপ্তাহে।
ও বাবাঃ, তিনমাস হয়ে গেল। আমিও মাল তুলতে পারছি না, একজনকে নিয়ে তো আমার কারবার নয়!
ও সপ্তাহে এসো।
পুরো চাইছি না, কিছু দিন।
কোত্থেকে দেব? পেমেন্ট চারমাস আটকে আছে।
কেন?
সেনগুপ্ত চারটে এয়ারকণ্ডিশনিং মেশিন কিনেছিল, চারটে স্ক্র্যাপ। মেশিন আমার অর্ডারে খাইয়ে ঝগড়া করে ক্যাপিটাল তুলে নিয়ে গেল। তখনো জানতাম না যে স্ক্র্যাপ মেশিন খাইয়ে গেছে প্যাটারসনে। প্যাটারসন থেকে সেদিন চিঠি এসেছে, মেশিন স্ক্র্যাপ, পেমেন্ট হবে না। সব বিল আটকে রেখেছে। সাত হাজার টাকার।
চুক-চুক করে জিভে একটা ক্ষোভের শব্দ করে মিশ্রিলাল।
সেনগুপ্ত ডুবিয়ে গেল একেবারে!
অমিয় একটু হাসে। বলে–ডুবিয়ে যাবে কোথায়? ঠিক পেয়ে যাব।
বিলটার জন্য কবে আসবে? আমার তো বেশি নয়, মোটে ন-শো টাকা। আমি গরিব মানুষ।
মিশ্রি, বিলের আশা ছাড়। বরং আমাকে আরও কিছু ধার দাও। নগদ না দিলে মাল দাও। আমার হাতে তিনটে টেণ্ডার। দুটো লোয়েস্ট হয়েছে, আর একটাও পেয়ে যাব। এখন সেনগুপ্ত নেই, আমি একা। টাকা মার যাবে না।
মিশ্রি গলা চুলকোয়। বলে–তিনমাস পেমেন্ট পাচ্ছি না। কী যে বলেন। পুরোনো লোক বলে ছাড়ছি না আপনাকে কিন্তু। কম্প্রেসারের পার্টসের জন্য লোকে ছিঁড়ে ফেলছে আমাকে। নগদ টাকার ছড়াছড়ি। এসব মাল এখন ক্রেডিটে দেয় কোনো বুদ্ধ?
অমিয় জলটা একটু একটু করে খায়। স্বাদটা ভালো লাগে। তেষ্টা পেয়েছে খুব। গ্লাসটা আবার ঢেকে রেখে বলে–এবার কাটো তাহলে।
সামনের সপ্তাহে আবার আসব।
রোজ আসতে পার। কিন্তু লাভ নেই।
বললেন যে আসতে। কিছু দেবেন। মোটে তো ন-শো টাকা।
ধৈর্যশীল মিশ্রিলাল ঝগড়া করে না। করলে করতে পারত। কিন্তু শান্ত মুখেই উঠে যায়। আবার ঠিক আসবে।
অমিয় নতুন টেণ্ডারের চিঠি দুটো টুকরো টুকরো করে ছেঁড়ে অন্যমনস্ক ভাবে; ছেঁড়া টুকরোগুলো টেবিলের ওপর সাজায় তাসের মতো। চেয়ে থাকে। সেনগুপ্ত কোথাও-না কোথাও আছে ঠিক। কলকাতা হচ্ছে একটি প্রকান্ড জলাশয়, তাতে ডুবসাঁতার কাটা যায়। কিন্তু একদিন-না-একদিন দেখা হবেই।
আজকালের মধ্যেই হাসি চলে যাবে। আজ বিকেলে বাসায় ফিরবার ইচ্ছে নেই অমিয়র। ফিরে খুব খারাপ লাগবে। হাসি যে কোথায় যাচ্ছে তা অমিয় জানে না। বোধহয় প্রথমে বাপের বাড়ি যাবে আসামে। তারপর বাগনানের কাছে এক গ্রামে, যেখানে ও চাকরি পেয়েছে, আগামী মাস থেকে চাকরি শুরু করবে। তারপর কী করবে হাসি? চাকরি করবে? তারপর? চাকরিই করবে! চাকরিই করে যাবে বরাবর! কিছু মনে পড়বে না! একা লাগবে না। খারাপ লাগবে না।