–তুমি কী করেছিলে?
–আমি! আমি কী করব? বোধহয় খুব চেঁচিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। তোরা মা-মরা দুটো ভাই-বোন কেন যে ওই বিদঘুঁটে খেলা করতে গিয়েছিলি! লোকে বলাবলি করেছিল যে তোদের ভূতে পেয়েছে। কেন গিয়েছিলি অমিয়?
-আমরা কী করে ফিরে এলাম আবার?
–কেউ ধরার আগেই তুই ঝাঁপ দিয়েছিলি জলে। তোকে কেউ ধরতে পারেনি। একা সাঁতরে এলি পাড়ে। খুব রোখ ছিল তোর।
–খুড়িমা, আমি একটা জলের স্বপ্ন খুব দেখি।
–কীরকম জল?
–অনেক জল, অথৈ জল। একটা খুব বড়ো নদী, তার ওপার দেখা যায় না। তার একধারে একটা বিরাট বালিয়াড়ি, আর একটা স্টিমার বাঁধার জেটি। সেখানে কেউ নেই। বালির ওপর একটা কেবল সাপের খোলস পড়ে আছে।
খুড়িমা হঠাৎ রোগা, মরা হাত বাড়িয়ে অমিয়র হাত ধরে। বলে–অমিয় কী বলছিস?
–একটা স্টিমারঘাটের কথা। একটা বালিয়াড়ির কথা।
খুড়িমা একটু চুপ করে থাকে।
–খুড়িমা তুমি এই স্টিমারঘাটের কথা কিছু জান?
খুড়িমা, আস্তে আস্তে একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। বলে–না তো! স্টিমারঘাটের কথা কী জানব! তুই কবে থেকে এটা দেখিস?
অমিয় একটু ভাবে। তারপর বলে–অনেকদিন থেকে। এক দিন ঘুমের মধ্যে ওই স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি। তারপর আবার ঘুমোই, আবার সেই স্বপ্ন। তিনবার করে স্বপ্নটা দেখে আর ঘুম হল না। একা একা শুয়ে খুব ভয় করতে লাগল। মনে হল, কেউ পাশে থাকলে খুব ভালো হত।
বউয়ের সঙ্গে কি তোর ঝগড়া অমিয়?
–কেন, ওকথা জিজ্ঞেস করছ কেন?
-এই যে বললি–তুই একা শুস। একা শুবি কেন অমিয়? বউ বিছানায় নেয় না? আলাদা শোয়? তা তার এত গুমোর কীসের? ওই জন্যই তোদের বাচ্চা হয় না
-খুড়িমা স্টিমারঘাটের কথাটা আগে শোনো।
–কী শুনব! স্টিমারঘাটের কথা আমি কিছু জানি না। রাখু ভাতটা টিপে দ্যাখ, হাঁ করে গল্প শুনছিস, ভাত গলে যাবে। একটু ডাঁটো থাকতে নামাস, অমিয় ঝরঝরে ভাত ভালোবাসে। ভাসান, কত রাত হল রে?
-নটা।
–অমিয় যাওয়ার সময় টর্চ জ্বেলে বড়োরাস্তা পর্যন্ত ওকে এগিয়ে দিস। আমি একটু চোখ বুজে থাকি। আমার মনটা ভালো লাগছে না।
–কেন খুড়িমা?
–তুই কেন স্টিমারঘাটের কথা বললি? ওসব অলক্ষুণে কথা, মন বড়ো খারাপ হয়ে যায়। খুড়িমা মশারির মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে নেয়, হাতপাখার মৃদু শব্দ হতে থাকে। রাখু এসে বলে–মামা, রান্না হয়ে গেছে। বসবেন না?
অন্যমনস্ক অমিয় ওঠে।
খেয়ে উঠে পোশাক পরছিল অমিয়। খুড়িমা ঘুমচোখে বলে-ভেজা পোশাক আবার পরছিস অমিয় ঠাণ্ডা লাগবে না? ওগুলো ছেড়ে রেখে যা
রাখু বলে–উনুনে ধরে শুকিয়ে দিয়েছি দিদিমা।
-ওতে কি শুকোয়? সেলাইয়ে জল থেকে যায়। স্টিমারঘাটের কথা যেন কী বলছিলি অমিয়?
-তুমি তো শুনতেই চাইলে না।
-খুড়িমা একটু অস্ফুট শব্দ করে। তারপর বলে–ছেলেবেলা থেকে তুই বড়ো একা। সেই জন্যে তোর দুঃখ নেই তো অমিয়? তোর মা-বাপ নেই–সে বড়ো দুঃখ। আমি তোর মা হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু চাইলেই কি হওয়া যায়। নিজের মেয়েটা, এই যে সব নাতি নাতনি-এ-সব থেকেও তো কেমন একা লাগে। রাত-বিরোতে ঘুম ভাঙলে কারো নাম মনে পড়ে না। ডাকতে গিয়ে দেখি, মাথা অন্ধকার লাগে। মনে হয় কেউ নেই আমার। সে বড়ো কষ্ট। ভাবি, মানুষের আপনজন কে-ই বা আছে! তুই কেন এসেছিলি যেন অমিয়?
–তোমাকে দেখতে।
একটা শ্বাসের শব্দ হল। খুড়িমা বিছানায় পাশ ফিরে শোয়। তারপর বলে–স্টিমারঘাটের কথা কেন বললি? কী জানি কেন, আমিও ঠিক একটা ধু ধু বালির চর দেখতে পাই এখন, অনেক দূরে একটা ঘাট, তারপর অথৈ জল… সাবধানে যাস অমিয়, উঠোনটা পিছল, রাস্তা ভালো না, অনেক রাত হয়েছে!
-খুড়িমা, তুমি ঘুমোও।
–ঘুম কী আসে। ভাসান, টর্চটা ধর। অমিয়, তোর বউয়ের নাম যেন কী?
–হাসি।
–হাসি! হাসির কেন বাচ্চা হয় না রে? আঁট-বাঁধ দিয়ে রেখেছিস নাকি?
–অমিয় চুপ করে থাকে।
–বাচ্চা না হলে বউ আপন হয় না। আঁটকুড়ি নয় তো? ডাক্তার দেখাস। তোর কেউ নেই অমিয়, বাচ্চা-কাচ্চা হলে একটু বাঁধা পড়বি। কিন্তু বয়স হলে আবার সেই
-কী?
–সেই যে কী যেন বললি! সেই স্টিমারঘাট–অথৈ জল…অমিয় সাবধানে যাস।
মেঘ কেটে ভয়ঙ্কর জ্যোৎস্না পড়েছে। অমিয় নির্জন রাস্তায় তার স্কুটার চালায়। বাতাস লাগে, জল-মাটির গন্ধ পায় সে। চলতে থাকে। হাসি এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। অমিয়র ঘুম হয় না আজকাল।
দূরে সিংহের ডাকের মতো মেঘগর্জন শোনা যায়। গির-অরণ্যে দেখা এক সিংহের অবয়বের ছায়া পড়ে অমিয়র চোখে। সে চলতে থাকে!
স্কুটারের শব্দ ঠিকই শুনতে পেল হাসি। আধো ঘুমের মধ্যেও। যেন এতক্ষণ সে এই শব্দের অপেক্ষায় ছিল। উঠে ঘড়ি দেখল সে। রাত এগারোটা বেজে গেছে। অমিয়র জন্য তার কোনো কৌতূহল নেই। সে শুধু আধো জেগে ছিল বলে মাঝে মাঝে রাস্তায় চলমান স্কুটারগুলির শব্দ শুনে উঠে একবার ঘড়ি দেখেছে। কোনো স্কুটারের শব্দই এতক্ষণ থামেনি।
হাসি শুনতে পেল, অমিয় স্কুটার টেনে সিঁড়ির নীচে উঠিয়ে রাখছে। আবার বিছানায় এসে শুয়ে থাকল হাসি। আগে আগে অমিয় এলে অন্তত খাওয়ার টেবিলে গিয়ে বসত সে। মুখোমুখি দু-চারটে কথা হত। খাওয়ার পর ছিল তাদের বাঁধা রতিক্রিয়া। এখন আর হাসি খাওয়ার টেবিলে যায় না।
সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসে অমিয়র পায়ের শব্দ, ভেজানো দরজা টেলে ও-ঘরে ঢোকে। জামাকাপড় ছাড়ে। বাথরুমে যায়।