–পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ।
-তবে? বয়সের হিসেব ঠিক রাখতে পারিস না তোরা। কাছে আয় তো দেখি, কীরকম ভিজেছিস!
খুড়িমা হাত বাড়িয়ে অমিয়কে ধরে কাছে টেনে নেয়। সমস্ত শরীরে মরা হাতখানা দিয়ে সেঁক দেওয়ার মতো চেপে চেপে ধরে তার শরীর দেখে।
–তুই কী পাগল? এমন কাক-ভেজা কেউ ভেজে? ভাসান, জামাকাপড় দে এক্ষুণি, তার আগে গামছা দে। রাখুকে বল এক পাতিল আগুন করতে, সেঁক না দিলে ও মরে যাবে।
-খুড়িমা, তুমি কেমন আছ?
-কী জানি! ডাক্তার বলেছে, ভালো না। কাপড়ে-চোপড়ে হেগে-মুতে ফেলি, আর বুকে একটা চাপ ব্যথা হয়। কতকাল আসিস না।
–আজ তো এলাম।
–এটা কীরকম আসা। তোর মাকে আমি রোজ স্বপ্নে দেখি। আমার ভরসায় তোকে ছেড়ে গিয়েছিল, তাই রোজ এসে খবর নিয়ে যায়। বাইরের নিমগাছতলায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে, ডাকে। বহু কালের পুরোনো ঝগড়া শত্রুতা তার সঙ্গে। ক-দিন পর আমিও তো তার কাছে যাব, এখন যদি তোর কিছু হয় তো সে আমাকে আস্ত রাখবে? এই বৃষ্টিতে ভিজে এলি, তুই কেমন পাগল? ও ভাসান–
–দিই।
–তাড়াতাড়ি দে।
–খুড়িমা, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি, চলে যাব। এখন আর জামাকাপড় ছেড়ে কী হবে?
-তোর বর্ষাতি নেই? ছাতা কিনিসনি? ওরে তোরা ওঠ, ও ভাসান, পাখিকে বল চা করবে, রাখুকে ঠেলে তুলে দে, পাতিলের আগুনটা করে দিক, আমি ওকে সেঁক দেব। অমিয়, কেন এসেছিস? অমিয়র বলতে ইচ্ছা করে, এই জন্যই। কিন্তু তা বলে না অমিয়, বলতে নেই। চুপ করে থেকে তার বুকে পিঠে মাথায় কঙ্কালসার হাতখানা অনুভব করে সে। এইটুকুর জন্য এত রাতে, দীর্ঘ পথ জল কাদা ঝোড়ো বাতাস ভেদ করে এসেছে সে।
–কেন এসেছিস? আমাকে দেখতে? আমি মরে গেলাম কিনা দেখতে এসেছিস? বলতে বলতে খুড়িমা একটু কাঁদে। বলে–সত্যিই খুড়িমাকে ভালোবাসিস অমিয়? তোর বউ বাপের বাড়িতে গেছে নাকি? বাচ্চা-কাচ্চা হবে না তো?
-না।
–তোর বাচ্চা হয় না কেন রে? অ্যাঁ! কী করিস তোরা? আঁট-বাঁধ দিয়ে রেখেছিস নাকি? বুড়োবয়সে হলে মানুষ করার সময় পাবি না। এখন হইয়ে ফেল।
-চুপ করো খুড়িমা।
–আমার তো ছেলে নেই। ভাসানকে বলি তোর খবর আনতে। তা সে তোর দোরগড়ায় গিয়ে গিয়ে ফিরে আসে, ভিতরে ঢোকে না, এসে বলে–মামা বাড়িতে থাকে না, মামিকে চিনি না, লজ্জা করে। আমি অবাক হই। মামিকে আবার চেনার কী আছে। গিয়ে কোলে বসে পড়বি, আবদার করবি, জ্বালাবি–তাতেই চিনবে।
-চুপ করো, তুমি চুপ করো।
–চুপ করব কেন? অমিয়, কেন এসেছিস?
–তোমাকে দেখতে।
ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে রাখি আর পাখি। কেটলিতে জল ফোটে। পাতিলে কাঠকয়লার আগুন জ্বালে রাখি। অমিয় খালি গায়ে, ধুতি পেঁচিয়ে বসে। তাকে ঘিরে হ্যারিকেনের আলোয় একটা ছোটো উৎসব শুরু হয়।
-আমার কেউ নেই অমিয়। শোভনা তার তিন ছেলে-মেয়ে রেখেছে আমার কাছে, রক্ষা। ভেবেছিলাম, শোভনা আমার মেয়ে আর তুই ছেলে। তুই কেমন ছেলে?
পাতিলের আগুনের ওপর দুই হাত মেলে ধরে খুড়িমা। গরম হাত দু-খানা এনে তার গায়ে চেপে চেপে ধরে। কতকালের পুরোনো এক রক্তস্রোত আর এক রক্তস্রোতের খবর নিতে থাকে।
রাখু, ভাত চড়াসনি?
–না তো! মামা কী খেয়ে যাবে?
–খেয়ে যাবে না তো কী? কোথায় খাবে?
–আমি খাব না খুড়িমা।
–কেন খাবি না? বউ রেঁধে রেখেছে বলে? গেরস্তর ঘরে কখনো ভাত নষ্ট হয় না। খেয়ে যা। আপিস থেকে এলি তো?
–হ্যাঁ।
–পাখি, তুই একটু হাত গরম করে সেঁক দে। আমি একটু শুই, বুকটা কেমন করে।
কথা বোলো না।
–বলব না! কেন? কাছে এসে বোস আরও। তোর বউকে বিয়েতে আমি গয়না দিইনি, না? কী দিয়েছিলাম যেন?
পাখি মুখ তুলে বলে–দিয়েছিলে। নাকছাবি।
-ওঃ। নাকছাবি আবার গয়না! অমিয়, তোর ছেলে-মেয়ে হলে একছড়া গোঠ দেব। তিন ভরি সোনা। তুই কোথায় থাকিস যেন?
–ঢাকুরিয়া।
–সে কী অনেক দূর? যদি দূর না হয় তো তোর বউ, কী-নাম যেন, তাকে নিয়ে আসিস। ভাসান, পাখি, তোরা ওর সঙ্গে কথা বলছিস না কেন? কথা বল।
–তুমি অত তাড়া দিলে কথা বলবে কখন? চা করছে, গা সেঁকছে, ভাত রাঁধছে, ওদের তো বসতেই দিচ্ছ না।
-তাড়া কী সাধে দিই! তোর মাকেই আমার ভয়। তার মুখের বড়ো ধার ছিল। এখনও এ বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরে জিভ শানাচ্ছে, আমি গেলেই ধরবে আমাকে। হ্যাঁ রে, পরের মেয়ে বউ হয়ে এসে আপনজন হয়ে যায়, আর পরের মা কিছুতেই কী মা হতে পারে না? কেন এসেছিস অমিয়?
-খুড়িমা, তুমি আমাকে গল্প বলো।
–কীসের গল্প শুনবি?
–আমার গল্প বললো। আমি কেমন ছিলাম?
–তুই? তুই আবার আলাদা কী ছিলি! আর পাঁচজনের মতোই ছিলি তুই। শিশুকালে সবাই এক থাকে, বড়ো হয়ে আলাদা রকমের হয়।
-তবু বলো।
–খুব দুষ্টু ছিলি। ভীষণ। মা ছিল না বলে তোর আদর ছিল সবচেয়ে বেশি। আশকারা পেয়ে মাথায় উঠেছিলি। তোর দিদি নানি সেই তুলনায় ঠাণ্ডা ছিল। পুরুলিয়ার বাড়িতে একটা মস্ত দিঘি ছিল–তার এপার-ওপার দেখা যায় না, তার কালো জল খুব গভীর, বড়ো বড়ো মাছ ছিল। দিঘির পারে একটা ডিঙিনৌকো বাঁধা থাকত–তাতে চড়ে মাঝ-দিঘিতে শ্বশুরমশাই মাছ ধরতে যেতেন। সেই…ডিঙিনৌকোয় চড়ে এক দুপুরে তুই আর নানি চুপি চুপি দিঘির মাঝখানে চলে গিয়েছিলি। চীৎকার শুনে আমরা দিঘির পাড়ে গিয়ে দেখি, নানি উঠে দাঁড়িয়ে বৈঠা তুলে চেঁচাচ্ছে, তুই নৌকোর এক ধারে ঝুঁকে আছিস। কেতরে নৌকোটা ভেসে আছে। সে যে কতদূর চলে গিয়েছিলি তোরা–এই টুকু টুকু দেখাচ্ছিল তোদের। চারদিক থেকে লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে কিন্তু তোরা এতদূরে যে পৌঁছোতে পারছিল না। নৌকোটা কেবলই কাত হচ্ছিল তখন, তুই ঝুলে ছিলি, পড়ে যাচ্ছিলি। কী ভয় আমাদের!