প্রবল বৃষ্টির ফোঁটা বর্শাফলকের মতো ঝকঝকে হয়ে ছুটে আসে। মুখের চামড়া ফেটে যায়। ব্রিজের সবচেয়ে উঁচু বিন্দুটিতে বাতাস লাগল। বৃষ্টির ফোঁটা খরশান। স্কুটার টাল খায়। এখানে ডানদিকে একটা অন্ধকার মাঠে বিস্ফোরকের মতো বিদ্যুৎ ফেটে পড়ে। এমন বাদলার দিন–এই দিনে হাসির কাছে ফিরে গিয়ে কী হবে অমিয়র?
অমিয় উৎরাই ভেঙে নেমে আসে। বড়ো রাস্তার ওপর ওই দেখা যায় অমিয়র বাসা। দোতলায় আলো জ্বলছে, উড়ছে সবুজ পর্দা। বাইরের দিকে একটা ঝুলবারান্দা। অমিয় একপলক তাকায়। তারপর অচেনা বাড়ির দিকে চেয়ে যেমন চলে যায় রাস্তার লোক, তেমনিই না থেমে চলতে থাকে অমিয়। স্কুটার ভেসে যায়।
৩. সোজা চলে স্কুটার
বহুদূর পর্যন্ত সোজা চলে তার স্কুটার। তারপর বাঁক নেয়। রাস্তার আলো এখানে ক্ষীণ, বহু দূরে দূরে। দু-ধারে গাছ-গাছালি, ব্যাঙের ডাক শোনা যায়, রাস্তায় লোকজন বিরল। এক আধটা দোকান খদ্দেরহীন, আলো জ্বেলে বসে আছে দোকানি। এই সব রাস্তা পার হয়ে অমিয়র স্কুটারের আলো পড়ে একটা লেভেল ক্রসিংয়ের সাদা লোহার গেটে। এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় লাফায় হাল্কা স্কুটার, ভেঙে পড়তে চায়। অমিয় দাঁতে দাঁত চেপে হাতল সোজা রাখে। লেভেল ক্রসিংয়ে লাইনের মাঝখানে গভীর খন্দ, তাতে জল জমে আছে। ঝাঁকুনিতে ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে পড়তে চায়। গর্তে পড়ে জলে ঢেউ তোলে স্কুটার। অমিয়র জুতো-মোজা ভিজে যায়। লেভেল-ক্রসিং পার হয়ে অন্ধকার কাঁচা রাস্তা। রাস্তার দু-ধারে ফাঁকা জমিতে দু-একটা ঘুমন্ত বাড়ি চোখে পড়ে। স্কুটার গোঙায়, তবু এগোয় ঠিক। বহুকাল আসা হয় না এদিকে। রাস্তাটা একটু গোলমেলে লাগে, স্কুটার থামিয়ে হেডলাইটটা বার কয়েক চারধারে ফেলে অমিয় স্কুটার ছাড়ে। এগোয়। অনেকটা গিয়ে ডানধারে ইটখোলাটা দেখতে পায় অমিয়। নাবাল মাঠে জল জমে গেছে। কী গম্ভীর ব্যাঙের ডাক। মনে হয় রাত নিশুতি হয়ে গেছে। ইটখোলার গা বেয়ে একটা গুঁড়ি পথ। দুধারে এই বর্ষায় আগাছা জন্মেছে খুব। পিছল হয়েছে রাস্তা, ক্ষয়ে গেছে। সেই রাস্তায় স্কুটার এগোয় না। এঁটেল মাটিতে চাকা পড়ে একই জায়গায় ঘুরতে থাকে। অমিয় টেনে তোলে। আবার এগোয়।
একটা নিমগাছ ছিল এখানে, আর কলার ঝাড়। সামনে উঠোন। মনে করতে চেষ্টা করে অমিয়। স্কুটার অনিচ্ছায় বহন করে তাকে। অনেকটা ভেতরে ঢুকে যায় সে। চারদিকে বাড়িঘর নেই। আলো নেই। কোনো মানুষ চোখে পড়ে না। অমিয় এগুতে থাকে। আঁকা বাঁকা পথে স্কুটার ঘোরে। কাদা ছিটকে আসে, ব্যাঙ লাফায়, জলের কলকল শব্দ হতে থাকে। বিদ্যুৎ চমকায় জলে-স্থলে। অমিয় প্রাণপণে চেয়ে দেখে, চিনতে চেষ্টা করে জায়গাটা। বহুকাল আসা হয়নি। বহুকাল।
স্কুটার লাফিয়ে উঠে একটা কলার ঝাড়ে আলো ফেলে এক মুহূর্তের জন্য। আভাসে একটা নিমগাছ দেখা যায় অবশেষে। উঠোন জলে ভাসছে। একটা অন্ধকার বেড়ার ঘর, টিনের চালে অবিরল বৃষ্টির শব্দ উঠছে। অমিয় স্কুটার থেকে নেমে উঠোনের আগল ঠেলে গোড়ালি ডুব জলে পা দেয়। ডাক দেয়–খুড়িমা! ও খুড়িমা!
দরজা খুলতেই একটা হ্যারিকেনের ম্লান, হলুদ আলো দেখা যায়।
–কে?
অমিয় বারান্দায় উঠে আসে। একটা স্যাণ্ডো গেঞ্জি গায়ে বোকা চেহারার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। শোভনাদির ছেলে ভাসান। অমিয় চিনতে পারে।
–ভাসান, আমি অমিয়মামা। খুড়িমা কেমন আছে?
ছেলেটা ঠিক চিনতে পারে না প্রথমে, বিশ্বাস করতে পারে না। বোকা চোখে চেয়ে থেকে একটু সময় নেয় বুঝতে। তারপর বলে–অমিয়মামা? তুমি এই রাতে? কী হয়েছে?
অমিয়র হঠাৎ লজ্জা করতে থাকে। কী বলবে সে! এত রাতে মানুষ বড়োজোর বাড়ি ফেরে। কোথাও যায় না।
ভেতর থেকে ঘুম ভাঙা বুড়ি-গলায় কে জিজ্ঞেস করে–কে রে? কে এল রে ভাসান?
–অমিয়মামা।
–কে অমিয়?
ভাসান আলোটা সরিয়ে দরজা ছেড়ে বলে–ভেতরে এসো অমিয়মামা। দিদিমা ভালো নেই। হার্ট খুব খারাপ।
অমিয় তার ভেজা জুতো ছাড়ে। জামা-প্যান্ট থেকে যতদূর সম্ভব জল ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করে। ঘরে ঢুকতেই ম্লান আলোয় বহুদিন আগেকার সেই ঘরখানা দেখে। হ্যারিকেনের গন্ধে ঘর ভরা, বিছানায় মশারি ফেলা! মশারির ভেতর হাতপাখা নাড়ার শব্দ। খুড়িমার কাছে মা মরার পর বহুদিন শুয়েছিল অমিয়। ঘুমের মধ্যেও খুড়িমার পাখা নড়ত নির্ভুলভাবে।
-কে এলি রে? মশারির ভিতর থেকে প্রশ্ন আসে।
–আমি খুড়িমা, আমি অমিয়।
একটা অস্ফুট শব্দ করে খুড়িমা, গোঁজা মশারির এক দিক তুলে বুড়ো মুখখানা বের করে। চোখে আলো লাগতে মিট মিট করে তাকিয়ে বলে–অমিয় মানে মেজোঠাকুরের ছেলে?
ভাসান ধমক দেয়–তো আর কে অমিয় আছে?
–হ্যারিকেনটা তোল তো ভাসান, দেখি। অমিয়, কাছে আয়। দেখি তোর গা। ঠিক তুই তো?
ভাসান বলে–-শার্টটা ছেড়ে ফেল অমিয়মামা। ইস! তুমি খুব ভিজে গেছ।
অমিয় বিছানার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলে–খুড়িমা, তুমি এত বুড়ো হলে কবে? এত বুড়িয়ে যাওয়ার কথা তো ছিল না তোমার।
–তুই কি এই বৃষ্টিতে এলি? কী হয়েছে তোর? খারাপ খবর আছে কিছু? কাছে আয়, দূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
-তুমি কাকার থেকে চোদ্দো বছরের ছোটো ছিলে, তবে বুড়ো হলে কী করে?
মশারি তুলে খুড়িমা উঠে বসে। গা উদোম। কাপড় খসে গেছে। কোমরের কাপড় ঠিক করতে করতে বলে–তোর কাকা গেছে বিশ বছর আগে, তখনই আমার পঞ্চাশ পুরে গেছে। বয়সের হিসেব তুই কি জানবি? মেজোঠাকুরের বুড়োবয়সের সন্তান তুই। তোর জন্মের সময়ে মেজোঠাকুরের বয়স পঞ্চাশ-বাহান্ন, তোর মার চল্লিশ। তোর এখন বয়স কত?