সেনের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে অমিয় মাথা নীচু করে ছিল।
রজত ইণ্ডিয়া কিংসের প্যাকেটটা ছুঁড়ে দেয় অমিয়র টেবিলে। বলে–আপনার ঠোঁটে সন্দেশের গুঁড়ো লেগে আছে বাগচী, মুছে নিন।
অমিয় একটু হাসে। সহজ হতে চেষ্টা করে। বলে–আমার দ্বারা সাপ্লাইটা হত না সেন।
রজত ভ্রূ কুঁচকে একটু তাকিয়ে থেকে বলে–গত তিন মাস আপনি বিজনেস পাননি বাগচী। এই অর্ডারটা ছাড়তে আপনাকে আমরা বারণ করেছিলাম।
–আমি পারতাম না।
–আমরা চালিয়ে দিতাম। আফটার অল উই আর কমরেডস।
রজত ওঠে। তার ডেস্ক, আলমারি বন্ধ করতে করতে হঠাৎ একটু হেসে বলে–-জার্মানি থেকে আপনাকে কী পাঠাব বলুন তো! ঘড়ি? শেভার? নাকি কলম? তার চেয়ে জব ভাউচার একটা পাঠিয়ে দেব বরং–কী বলেন?
রজত নিজেই হাসে–কিন্তু মিসেসকে রেখে আপনি তো যাবেন না। গিয়েও শান্তি পাবেন না। ম্যারেডদের ওই এক বিপদ।
সে-কথার উত্তর না দিয়ে অমিয় তার গভীর অন্যমনস্ক মুখ তুলে বলে–সেন, লক্ষ করেছেন কালীচরণের পায়ের কোনো শব্দ হয় না।
-কী বলছেন? রজত ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে।
–বলছি, যাদের পায়ের শব্দ হয় না তারা খুব ডেঞ্জারাস। সেনগুপ্তরও হত না।
সেনগুপ্তর উল্লেখে রজতের মুখটা ঝুলে পড়ে। চাপা গলায় সে বলে–বাস্টার্ড। আপনাকে কী সেনগুপ্ত হিপনোটাইজ করেছিল বাগচী? কী করে তবে সে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের টাকা তুলে নিল, আদায় করে নিল চার চারটে বিল-পেমেন্ট, সমস্ত লায়েবিলিটি কী করে আপনার ঘাড়ে ফেলে গেল?
অমিয় একবার হাত উলটে তার অসহায়তা প্রকাশ করে মাত্র। কথা বলে না। হতাশ গলায় রজত বলে–ব্যবসা আপনার কর্ম নয় বাগচী। আপনি ভীতু হয়ে যাচ্ছেন, লোককে দাবড়াতে পারেন না।
সেনগুপ্তর পায়ের কোনো শব্দ হত না–এই সত্যটা আবিষ্কার করে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে অমিয়। কালো ছিপছিপে সুপুরুষ এবং হিংস্র সেনগুপ্ত ছিল বার্ড কোম্পানির চাকরে। চাকরি নামে মাত্র, সে ছিল কোম্পানির টিমের নামকরা গোলকিপার। খেলার জন্যই চাকরি পেয়েছিল। পোস্ট থেকে পোস্টে উড়ে শট আটকাত, বহুবার পেনালটি ধরেছে। অবধারিত একটা লিফট পেত, কিন্তু সেবার হাঁটুর মালাইচাকি ভেঙে পড়ে রইল ছ-মাস। উন্নতির আর আশা নেই দেখে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে এল অমিয়র সঙ্গে।
তখন অমিয় মারাত্মক পোশাক পরত, দারুণ হাসত, পিচের রাস্তার মতো গড়গড়ে ইংরেজি বলত। সাপের মতো সাবলীল ছিল তার নড়াচড়া, ক্রুর চোখ, ঘন ভ্রূ। সেনগুপ্ত তার দিকে সম্মোহিতের মতো চেয়ে থাকত। একটা সময় ছিল যখন সেনগুপ্তর মতো বিপজ্জনক ছেলেকে নিপুণভাবে চালাত অমিয়। তখন সাপ্লায়ারেরা সাবধানে মাল দিত, ছ-মাস ন-মাস তাগাদা করত না। অর্ডার আসত ঝাঁকে ঝাঁকে। চোখা, চালাক, সাহসী অমিয় হিংস্র, মারকুট্টা সেনগুপ্তকে ব্যবহার করত ব্যবসার ডেকর হিসেবে, কখনো তাকে বানাত দেহরক্ষী, কখনো তাকে আউটডোরে ঘুরিয়ে আনত সেলসম্যান হিসেবে! সেনগুপ্তকে তৈরি করেছিল সে-ই। তারপর কবে থেকে–কবে থেকে যেন–বহু দূরের এক অচেনা নির্জন ফেরিঘাট জাহাজের মতো ধীরে অমিয়ের কাছাকাছি চলে আসতে থাকে। তখন থেকেই সে মাঝে মাঝে সেনগুপ্তর দিকে চেয়ে ভয় পেয়ে চমকে উঠত। সে দেখতে পেত–তার সামনে স্বাভাবিক পোশাক পরা সেনগুপ্ত নয়-সেনগুপ্তর পরনে কালো শর্টস, লাল টুকটুকে গেঞ্জি, দস্তানা পরা দুটো হাত থাবার মতো উদ্যত হয়ে আছে, মাথায় টুপি, টুপির ছায়ায় দুটো আলপিনের মতো চোখ, ফণা তুলে দুলছে এক হিংস্র গোলকিপার, অমিয়র সব রাস্তা বন্ধ করে সে দাঁড়িয়ে।
মানুষের পতনের কোনো শব্দ হয় না। তবু আশপাশের কিছু লোক ঠিক কেমন করে টের পায়, এ লোকটার দিন শেষ হয়ে এসেছে। কোনোদিন দীর্ঘ টেণ্ডার টাইপ করতে করতে হঠাৎ চোখ তুলে সেনগুপ্ত হয়তো দেখেছিল, অমিয় ভীত চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। কিংবা হয়তো কোনোদিন অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে দু-জনে বেরোনোর সময় অন্ধকার সিঁড়িতে সেনগুপ্তর আগে আগে নামতে দ্বিধা করেছে। কিংবা এরকমই কোনো তুচ্ছ কিছু লক্ষণ দেখেছিল সেনগুপ্ত। বুঝেছিল ব্যবসাতে অমিয়র দিন শেষ, তার শুরু। বুঝেছিল সাপ্লায়াররা, পারচেজাররা। বুঝেছিল আরও অনেকে। সবার শেষে বুঝেছে অমিয়। স্পষ্টই নিজের ভেতরে সে এখন এক দিনাবসান টের পায়, প্রত্যক্ষ করে সূর্যাস্ত। বহু দূর থেকে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে এক নির্জন ফেরিঘাট, তার জেটি, তার অতলান্ত জল…অমিয় মুখ তোলে–কিছু বলছেন সেন?
-একটা মেয়েকে কী করে রিফিউজ করতে হয় বাগচী? আমি কোনো ল্যাংগুয়েজ খুঁজে পাচ্ছি না। নাকি জার্মানিতে গিয়ে চিঠি দেব?
অমিয় একটু হাসে–ল্যাংগুয়েজের দরকার হয় না সেন। রিফিউজাল মনে থাকলেও লোকে ঠিক বুঝে নেয়। ডোন্ট বদার।
–মাইরি! তাহলে বেঁচে যাই।
অমিয় হাসে।
–চলি বাগচী। সিগারেটের প্যাকেটটা আপনি রেখে দিন। যদি রায়চৌধুরি আমার মোটর পার্টস নিয়ে আসে তবে আমার হয়ে ওর পাছায় তিনটে লাথি কষবেন–তিনটে–ভুলবেন না।
অমিয় অনেকক্ষণ বসে থাকে। অফিসঘরটা অন্ধকার হয়ে আসে। অমিয় আলো জ্বালে না। রাস্তার নানা আলোর ছায়াছবি এসে সিলিংয়ে কাঁপতে থাকে, দেয়ালে চমকায়। কাকের পাখার মতো অবসাদ নেমে আসে অমিয়র শরীর জুড়ে।