চলে যাবে বলে উঠে দাঁড়িয়েছিল অমিয়, ঠিক সে-সময়ে নিঃশব্দ পায়ে কালীচরণ এল। সিঁড়িতে ওর পায়ের শব্দ হয়নি। অমিয় একটু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।
-চলে যাচ্ছিলেন? কালীচরণ জিজ্ঞেস করে। তার মুখে ঘাম, উৎকণ্ঠা।
–হুঁ।
–আমি আপনার কাছেই এসেছিলাম।
অমিয় চুপ করে থাকে।
–গত দুমাস কিছু চাইনি। জানতাম আপনি অসুবিধেয় আছেন। কিন্তু এখন আমার বড়ো ঠেকা। পেমেন্টের একটা তারিখ দিন এবার।
অমিয় জিজ্ঞেস করে–সিঁড়িতে তোমার পায়ের শব্দ হয়নি কেন কালীচরণ?
কালীচরণ একটু থমকে যায়। চেয়ে থাকে। অমিয় হাত বাড়িয়ে ওর ঘেমো হাতখানা ছুঁয়ে বলে–কাঠের সিঁড়িটা বড়ো পুরোনো হয়েছে, বেড়াল বাইলেও শব্দ হয়। তুমি কী করে শব্দ না করে উঠলে? তুমি বেঁচে আছ তো! ভূত হয়ে আসনি তো কালীচরণ? কিংবা পাখায় ভর করে?
কালচীরণ একটু হেসে একটা ময়লা রুমালে মুখ মোছে। তার গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হার্ডওয়ার বাজার যদিও কালীচরণের পায়ের তলায়, কিন্তু তবু বাইরের চেহারায় সে ভদ্রলোক থাকেনি। ময়লা মোটা ধুতি, গায়ে লংক্লথের হাফ-হাতা জামা, পায়ে টায়ারের চটি।
–বাগচীবাবু, আমার মেয়ের বিয়ে। তিনহাজার যদি আপনার কাছে আটকে থাকে তো আমি গরিব, কী দিয়ে কী করব?
অমিয় একটু চুপ করে থাকে। তারপর হঠাৎ বলে–দুটো সরকারি অর্ডার আছে কালীচরণ, পনেরো হাজার টাকার। করবে?
-আপনি পেয়েছেন?
আমিয় মাথা নাড়ে–আমারই। কিন্তু আমি করব না। তুমি করো তো তোমাকেই ছেড়ে দিই।
কালীচরণ সতর্ক গলায় জিজ্ঞেস করে–আপনি কত পারসেন্ট নেবেন?
–এক পয়সাও না। শুধু পেমেন্টের জন্য আমাকে একটু সময় দাও।
–অর্ডার দেখি–বলে কালীচরণ হাত বাড়ায়।
অমিয় অর্ডারের কাগজপত্র বার করে দেয়।
–কালীচরণ কয়েক পলক অর্ডারের কাগজপত্র দেখে বলে–মাত্র আট পারসেন্ট উঁচু দর দিয়েছেন! তাও হচ্ছে একমাস দেড়মাস আগেকার দর। গত একমাসে মেশিন পার্টস, কয়েল আর স্প্রিংয়ের দর দশ থেকে কুড়ি পারসেন্ট বেড়েছে। পনেরো হাজার টাকার অর্ডার, অফিসার আর বিল ডিপার্টমেন্টকে খাইয়ে হাজার খানেকও ঘরে তোলা যাবে না। পরিশ্রম পোষায়?
–তুমি করবে না?
কালীচরণ একটু হাসে-–করব না কেন? ব্যবসা চালু রাখতে হলে কাজ ধরতেই হবে, লোকসান হলেও।
গায়ের জামা খুলে স্যাণ্ডো গেঞ্জি গায়ে রজত টেবিলের ওপর শুয়ে ছিল। তার রায়চৌধুরি এখনও আসেনি। শুয়ে থেকেই মুখ ফিরিয়ে বলল–কালীচরণ, বাগচীর জায়গায় আমি হলে অর্ডার দুটো কেড়ে নিয়ে তোমাকে ঘাড়-ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতাম।
-কেন?
–সরকারি অর্ডারের জন্য হাজারটা লোক হন্যে হয়ে ঘুরছে। তুমি ভদ্রলোক হলে লোকসানের কথা বলতে না। পনেরো হাজারে তোমার অন্তত ছ-হাজার মার্জিন থাকবে।
কালীচরণ বিড় বিড় করে বলে–দেনা পাওনার কথা উঠলেই সব জায়গায় খিচাং।
রজত ধমক দিয়ে বলে-দেনা-পাওনা আবার কী? বাগচীর তিন হাজার ওই অর্ডারে শোধ হয়ে গেল। আর এসো না।
তার মানে? তিন হাজার টাকা আমি এখনো পাই
–না পাও না। তোমাকে সেনগুপ্ত এনেছিল, তার আমলে তুমি সাপ্লায়ার ছিলে। পারো তো তাকে খুঁজে বের করো।
তাকে পাব কোথায়?
–বাগচী তার কী জানে কালীচরণ? ছোটো কোম্পানি, আট-দশ হাজার টাকা ক্যাপিটাল তুলে নিয়ে গেল, আর লায়বিলিটি সব রেখে গেল–এটা কী মগের মুল্লুক?
–আমি তার কী জানি?
-তোমাদের সঙ্গে সেনগুপ্তর ষাট আছে, আমি জানি! সে-ই তোমাদের পাঠাচ্ছে তাগাদায়। যাতে বাগচী বিপদে পড়ে। বাগচী ভালো লোক কালীচরণ, দেনা সে সব মেনে নিচ্ছে, সরকারি অর্ডার বিলিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু মনে রেখো গড়বড় করলে ঝামেলা হবে।
কালীচরণ চুপ করে থাকে।
রজত হাই তুলে বলে–সকলের দিন সমান যায় না। বাগচী তোমাদের অনেক বিজনেস দিয়েছে। এখন বেরোও
কেউ তার হয়ে বোঝাপড়া করুক, কিংবা তাকে করুণা করুক, এটা আজও পছন্দ করে না অমিয়। সেইটুকু অহঙ্কার তার এখনও আছে। তবু সে কিছুই বলে না। চেয়ে থাকে।
দুর্বল চোখে একটু চেয়ে থেকে কালীচরণ উঠে পড়ে।
শ্লথ ভঙ্গীতে টেবিল থেকে রজত তার চেয়ারে নেমে বসে। অলস ভঙ্গিতে বুশ-শার্টটা চেয়ারের পিঠ থেকে খুলে নিয়ে গায়ে দিতে দিতে অমিয়র দিকে তাকায়। চোখে ভর্ৎসনা।
কেমন লজ্জা করে অমিয়র। চোখ সরিয়ে নেয়। অর্ডার দুটো রাখবার জন্য তাকে অনেকবার কল্যাণ বলেছিল। তিন-চার মাস কোনো অর্ডার পায়নি অমিয়, এই দুটো পাওয়াতে দিন সাতেক আগে তারা তিনজন অফিসঘরে একটা ছোট্ট উৎসব করেছিল। সবীর থেকে রেজালা আর তন্দুরী রুটি এসেছিল, আর কে-সি দাসের সন্দেশ। কল্যাণ মুখার্জি, রজত সেন আর অমিয় বাগচী–তারা কেউ কারো বন্ধু নয়। একটা ঘরে তিনটে টেবিলে তাদের তিনটে আলাদা কোম্পানি। যে যার ব্যবসার ধান্দায় ঘোরে। রোজ দেখাও হয় না। কিংবা খুব কম সময়ের জন্য দেখা হয়। তবু কী করে যেন তাদের মধ্যে বুনো মোষের মতো পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ততা এসে গেছে। তারা কেউ কখনো তিনটে কোম্পানিকে এক করার কথা বলেনি। তারা বন্ধুও নয়, তাহলে কী? তা ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু বাগচীর কিছু হলে আপনা থেকেই রুখে দাঁড়ায় মুখার্জি আর সেন, যেমন সেনের কিছু হলে রুখে ওঠে বাগচী আর মুখার্জি। বোধহয় এই ঘরটাই তাদের এই সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছে।