উঠে মধুকে ডাকে হাসি-ঘরগুলো খুঁজে দেখো মধু, ইঁদুরগুলো কোথায় কোথায় মরে পড়ে আছে। পচে গন্ধ বেরোবে।
চারটে বেজে গেছে। জামাইবাবুকে একটা ফোন করা দরকার। রিজার্ভেশনটা যদি পাওয়া যায়।
জলে কলকাতার ভঙ্গুর প্রতিবিম্ব পড়েছে, ভেঙে যাচ্ছে। জল হলে এক কলকাতা অনেক কলকাতা হয়ে যায়। ঢাকুরিয়া থেকে বাস ধরে হাসি গড়িয়াহাটায় এসে পেট্রোল পাম্প থেকে জামাইবাবুর অফিসে টেলিফোন করে।
–জামাইবাবু, আমি হাসি।
–বলো।
–আমার রিজার্ভেশনের কী হল?
–হয়নি। দার্জিলিং মেলে ভীষণ ভীড় হচ্ছে। এখন সামার-রাশ।
রেলে যে কে আপনার বন্ধু আছে চেকার?
–থাকলেই বা, সিটি বুকিংগুলো দেখে এসো না। তিনদিন ধরে লাইন দিয়ে বসে আছে। লোক–কোথায় কত টিকিটের কোটা আছে সব তাদের মুখস্থ, একটা টিকিট কম পড়লে আস্ত রাখবে?
-এত লোক যাচ্ছে কোথায়?
-কলকাতা থেকে পালাচ্ছে; আবার কলকাতার পালিয়ে আসবে বলে।
–আমার মনে হয়, আপনি গা করছেন না।
–তা তো করছিই না।
–কেন?
-তুমি সুখের পাখি উড়ে যাবে, আর আমরা পড়ে থাকব হাঁফিয়ে ওঠা ভ্যাপসা কলকাতায়–তা কী হয়!
–আমার যে যাওয়াটা দরকার।
-কেন?
যাব না কেন?
ওপাশে জামাইবাবু একটা শ্বাস ফেলে।
-হাসি, গতকাল অমিয় আমার কাছে এসেছিল।
হাসি তীক্ষ্ণ গলায় বলে–কেন?
–ভয় পেও না। সে তোমার চলে যাওয়া আটকানোর ষড়যন্ত্র করতে আসেনি।
হাসি চুপ করে থাকে।
-ও এসেছিল একটা স্টিমারঘাটের কথা বলতে।
–স্টিমারঘাট!
–স্টিমারঘাট। ও আজকাল মাঝে মাঝে একটা স্টিমারঘাট দেখতে পায়।
তার মানে?
তার মানে তোমাকেই আমরা জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম।
স্টিমারঘাটের কথা আমি কী জানি। কোথাকার স্টিমারঘাট।
তার আগে বলো, ওর ব্যবসার অবস্থা কী?
হাসি একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে–বোধহয় ভালো না। বাজারে অনেক ধার জমে গেছে।
–আর এ সময়ে তুমি সুখের পাখি উড়ে যাচ্ছ?
–আমি কী করব জামাইবাবু?
ওপাশে জামাইবাবু আবার চুপ।
–আমার রিজার্ভেশনের কী করবেন বলুন? কাছে-পিঠের রাস্তা হলে আমি রিজার্ভেশন ছাড়াই চলে যেতাম। কিন্তু চারদিন ধরে যাওয়া তো সেভাবে সম্ভব না।
-দেখছি।
–আমার কিন্তু সময় নেই। আর পনেরো দিনের মাথার খুশির বিয়ে। তারপর ফিরে এসে স্কুলে জয়েন করব। বুঝলেন?
-বুঝেছি। কিন্তু অমিয়র স্টিমারঘাটের কী হবে?
–আমি কী জানি।
–হাসি, অমিয়র ওজন কত?
হাসি হেসে ফেলে। বলে–আমি কি দাঁড়িপাল্লা?
-না। কিন্তু বউরা তো স্বামীর ওজন জানে। জানা উচিত।
-ফোন রেখে দেব কিন্তু।
–আমি ইয়ার্কি করছি না। অমিয়কে দেখে মনে হয় অন্তত কুড়ি কে.জি. ওজন কমে গেছে।
হাসি একটা শ্বাস ফেলে। অমিয় বোধহয় তাকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু তাতে হাসির কিছু যায় আসে না।
জামাইবাবু, আমি ওর সঙ্গে ঝগড়া করি না। আমাদের মধ্যে কোনো ভুল-বোঝাবুঝি নেই।
-তোমার দিদির সঙ্গে আমার রোজ চারবার করে ঝগড়া হয়, আর ভুল বোঝাবুঝি? আমার জীবনে কেউ কাউকে বুঝব না। কিন্তু গত চারমাসেও আমার ওজন দু-কে.জি বেড়েছে।
–ওজনের কথা বলছি না।
–আমি ওজনের পয়েন্টেই স্টিক করতে চাই। হাসি, অমিয়র ওজন কমে যাচ্ছে কেন?
–আমার রিজার্ভেশনের কথাটা মনে রাখবেন। ছেড়ে দিচ্ছি
— –ছেড়ো না। শোনো, স্টিমারঘাটের কথা ও তোমাকে কখনো বলেনি?
–না।
-আশ্চর্য!
–আশ্চর্যের কী? ও আমাকে অনেক কথাই বলে না।
–কিন্তু স্টিমারঘাটের ব্যাপারটা বলা উচিত ছিল।
—কেন?
–স্টিমারঘাটটা ও খুব স্পষ্ট দেখতে পায়, আর এমনভাবে বলে যে আমিও যেন সেটা দেখতে পাই। শুনতে শুনতে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিল।
-কীরকম স্টিমারঘাট সেটা?
–খুব উঁচু একটা বালিয়াড়ি বহুদূর গড়িয়ে নেমে গেছে…কিন্তু ফোনে অত সব বলা যায় না। তুমি ওর কাছে শুনো।
–আমি শুনব কেন জামাইবাবু? আমার কৌতূহল নেই।
–তুমি আসাম থেকে কবে ফিরবে হাসি?
–বললাম তো, খুশির বিয়ে হয়ে গেলেই। ফিরে এসে স্কুলে জয়েন করব।
–সেটা তো ফেরা নয়। স্কুলে মানে বাগনানের কাছে যাবে, গ্রামে। কিন্তু তুমি অমিয়র কাছে কবে ফিরবে হাসি?
হাসি উত্তর দেয় না। ফোনটা খুব আস্তে ক্র্যাডলে নামিয়ে রাখে।
আজ কলকাতা বৃষ্টির পর বড়ো সুন্দর সেজেছে। সূর্যের শেষ আলো সিঁদুর-গোলা রং ঢেলেছে রাস্তায় রাস্তায়। গড়িয়াহাটার বাড়িগুলোর গায়ে সেই অপার্থিব রং জলে ছায়াছবি। রাস্তাগুলো ভেজা, রাস্তার নীচু অংশে পাতলা জলের স্তর জমে আছে। সেই জল থেকে আলোর অজস্র প্রতিবিম্ব উঠে আসে। একা একা হাঁটতে বড়ো ভালো লাগছে হাসির। মোড়ের দোকানগুলোর শো-কেশে সে সুন্দর শাড়িগুলো ঘুরে ঘুরে দেখল একটু। পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগল। কী ভিড় চারদিকে! তবু এ ভিড় বড়ো রঙিন। বাগনান থেকে হয়তো প্রায়ই আসা হবে না, কিন্তু পুরোনো ভালোবাসার টানে ছুটি-ছাটায় ঠিক চলে আসবে হাসি, উঠবে চিৎপুরে দিদি জামাইবাবুর কাছে। একা একা ঘুরবে কলকাতায় যেমন সে গত তিনবছর ধরে ঘুরেছে এবং ক্লান্ত হয়নি। কলকাতার রূপ কখনো ফুরোয় না।
একটা মরা বেড়াল পড়ে আছে বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি হয়ে। ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নামতে বেড়ালটাকে ডিঙিয়ে গেল হাসি। পচা গন্ধ, কাছেই বসে কোনো নেমন্তন্ন-বাড়ির এঁটো-কাঁটার রাশ খবরের কাগজে জড়ো করে বসেছে এক ভিখিরি মেয়ে তার বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে। হাসি ট্রাম লাইন পেরিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। তার মন বলে, আজও বলে– কলকাতা, কলকাতা।