শিলচর ছিল সুন্দর ছিমছাম শহর। লোকজন বেশি না, গাড়িঘোড়া বেশি না, চারদিকে জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট শহর। সেখানে মাসির বাড়িতে এসে সে প্রথম শহরের স্বাদ পায়। সুন্দর সেই স্বাদ। তখন তার মনে কলকাতার বীজটি ফেটে অঙ্কুর দেখা দিয়েছে। সে বুঝতে পারে–শহর-শহরের মতো জায়গা নেই। সাতবছর সে শিলচরে কলকাতার আরও বিচিত্র গল্প শোনে বন্ধুবান্ধবীর কাছে। মাসিদের আত্মীয় হারুকাকার ক্যান্সার হয়েছিল, সে গেল চিকিৎসার জন্য কলকাতায়। শচীন নামে কলেজের একটি ছেলে বেশ কবিতা লিখত, সে গেল কলকাতায় বড়ো কবি হওয়ার জন্য। অনুরাধা ক্লাসিকাল গাইত গৌহাটি রেডিয়ো থেকে। সে প্রায়ই বলত–মফস্বলে কিছু হয় না, শিখতে হলে যেতে হবে কলকাতা। হাসির মন বলতে থাকে–কলকাতা, কলকাতা। তুমি গান গাও? নাচো? কবিতা লেখো? তুমি চাকরি চাও? উন্নতি চাও? তোমার মরণাপন্ন অসুখ! তবে কলকাতা যাও। যাও কলকাতায়। একবার কলকাতা থেকে ঘুরে এসো। মানুষকে কলকাতা সব দিতে পারে। খ্যাতি, টাকা, প্রাণ পর্যন্ত। কলকাতা থেকে যারা শিলচরে ফিরে যায় সেই সব বন্ধুদের কাছ ঘেঁসে কলেজে বসত হাসি। দেখত—ঠিক। ওদের মুখে-চোখে আলাদা দীপ্তি, ঝলমলে আনন্দিত ওদের পোশাক, গায়ে কলকাতার মিষ্টি গন্ধ। মাসিকে বলত–মেসোকে বলত–কী গো তোমরা! ভারী ঘরকুনো, চলো একবার কলকাতা যাই। মাসি মেসো সমস্বরে বলত–সে ভারি দুরের রাস্তা, পথের কষ্ট খুব, একগাদা টাকা খরচ, তা সেখানে গিয়েই বা হবে কী? যা ভিড়, গন্ডগোল, মারপিট আমাদের মতো সুন্দর নিরিবিলি শহর নাকি সেটা? চোর পকেটমার, রকবাজ ছেলে, রাজনীতি –দূর দূর।
যাওয়া হত না। হত না বলেই হাসির কল্পনায় কলকাতা ক্রমে ক্রমে এক বিশাল ব্যাপক রাজত্ব স্থাপন করে। কলকাতায় যেন বা আলাদা সূর্য ওঠে, আলাদা চাঁদ, কলকাতা শূন্যে ভাসমান বুঝি বা। কলকাতাকে ঘিরে যেসব কল্পনা হাসির–সেসব কল্পনা কলকাতার দিগ্বিজয়ী সৈন্যদলের মতো তার ভিতরটা তছনছ করে দিয়ে যেত। কলকাতা কল্পনা-লতা তার ওপর দু-চোখের পল্লবের ছায়া ফেলেছিল। কলকাতা বলে বোধ হয় কিছু নেই তবে। লোকে কেউ কখনো যায় নি। সবাই মিলে যোগাযোগ করে বানিয়েছে গল্প। যারা কলকাতার কথা জানে তারা নিজেদের মধ্যে চোখ টেপাটেপি করে, কানাকানি করে, যুক্তি করে, হাসিকে এক কাল্পনিক শহরের কথা শোনায়। কলকাতার খন্ডিত ছবি সে অনেক দেখেছে ভূগোলের বইতে, খবরের কাগজে, ক্যালেণ্ডারে। কখনো জি-পি-ওর ঘড়ি, হাওড়া ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া, মনুমেন্ট, তা থেকে কিছু বোঝা যায় না। ক্রমে সে বুঝতে পারে, কলকাতার দৃশ্য নয়, রাস্তা ঘাট আলো নয়; নয় তার দোকানপাট কিংবা বিচিত্র পসরা–এসবের অতীত, কিংবা এসব মিলিয়ে কলকাতা এক মন্ত্রের মতো। কিংবা কলকাতা কি জ্বলন্ত পুরুষ, তার বুকে রহস্যের শেষ নেই, সীমাহীন তার নিষ্ঠুর উদাসীনতা, চুম্বকের মতো তার আকর্ষণ! দূরদূরান্ত থেকে প্রেমিকারা চলেছে কলকাতার দিকে! কেবলই চলেছে!
কলকাতা এক প্রেমিকেরই নাম। জ্বলন্ত দুর্বার এক প্রেমিক পুরুষ। কলকাতায় একবার গেলে আমি আর ফিরব না, ভাবত হাসি।
হাসি লেখাপড়া শিখত কলকাতায় যাবে বলে। গান শিখত, নাচ শিখত–কলকাতায় যেতে হলে কোনটা যে দরকার হবে, কোনটার সূত্রে কলকাতায় যাওয়া হবে তা বুঝতে পারত না। কিন্তু হাস্যকর হলেও একথা খুবই সত্য যে তার সব কিছুর পিছনেই ছিল কলকাতা, কলকাতা। বিয়ের সম্বন্ধ মাসিই খুঁজছিল। হাসি একদিন খুব লজ্জার সঙ্গে তাকে বলে–যদি বিয়ে দাও তো কলকাতায় দিও। মাসি অরাজি ছিল না। কিন্তু অত দূরের পাল্লায় ঠিকমত যোগাযোগ কে করে!
সেই সময়ে ডিগবয়ের তেল কোম্পানির এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে চমৎকার সম্বন্ধ এসে গেল হাসির। বিলেত-ফেরত ছেলে, বেশ স্মার্ট চেহারা, দেড়-দুই হাজার মাইনে। হাসিকে পাত্রপক্ষ পছন্দও করে গেল। মণিপুরি নাচে, রবীন্দ্র-সংগীতে শিলচরে তখন হাসির বেশ নাম। রং চাপা হলেও বড়ো সুশ্রী ছিল হাসি। সবাই জানত হাসির ভালোই বিয়ে হবে। হয়েও যাচ্ছিল। পাত্রের ঠাকুমা মারা গিয়েছিল মাস আষ্টেক আগে, চারমাস পর কালাশৌচ কাটবে। তখন অস্থি বিসর্জন দিয়ে বিয়ে হবে–ঠিক হয়েছিল। হয়ে গেল পাটিপত্র, এমনকী আশীর্বাদের ব্যাপারে কালাশৌচ ওঁরা মানেননি। হাতে তখন চারমাস সময়। মাসির অ্যালবামে পাত্রের ফোটো সাঁটা হয়ে গেছে, পাশে হাসির ফোটো। মাসি মাঝে মাঝে হাসিকে অ্যালবামের সেই পাতাটা খুলে দেখাত–দ্যাখ হাসি।
হাসির মন বলত–কলকাতা, কলকাতা। বহু দূরে এক বিশাল পর্বতের মতো বহ্নিমান পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। চতুর্দিককে কেন্দ্রাভিগ আকর্ষণে টানছে চুম্বক পাহাড়ের মতো। সেখানে গেলে ফিরত না হাসি। যাওয়া হবে নাকি!
কাছাড়ের এক লোকনাট্য দল সেবার কলকাতায় যাচ্ছে। তারা হাসিকে দলে নিতে রাজি। হাসি মাসিকে গিয়ে ধরল–এখনও চারমাস বাকি। একবার ঘুরে আসি মাসি। মাত্র তো পনেরোটা দিন।
–বিয়ের আগে কলকাতায় গিয়ে নাচবি গাইবি, সেটা কি ভালো দেখাবে? পাত্রপক্ষ যদি কিছু মনে করে।
হাসি হাসে–কলকাতার জলে রং ফর্সা হয়, জান না?
অনেক বলা-কওয়ার মাসি রাজী হল।
কলকাতা কীরকম দেখতে তা আজও হাসি সঠিক জানে না। প্রথম দিনের মতোই। বহুদূর থেকে একটা যৌবনকালের প্রতীক্ষা নিয়ে সে যখন কলকাতায় নামল তখন আর রাস্তার কষ্টের কথা মনেও ছিল না, খুব পিপাসা পেয়েছিল, বিবেকানন্দ ব্রিজ পেরিয়ে আসার সময়ে যে গুম গুম আওয়াজ করেছিল রেলগাড়ি, সেই আওয়াজ শিয়ালদা পর্যন্ত তার বুকের ভেতরে কলকাতার শব্দ তরঙ্গ তুলেছিল। শিয়ালদার ঘিঞ্জি কলকাতা সে তো চোখে দেখেনি। শুভদৃষ্টির সময়ে কেউ কী বরের মুখ ঠিকঠাক দেখতে পায়, নির্লজ্জ ছাড়া? সে গাড়ি থেকে প্ল্যাটফর্মে পা দিতেই এক দুরন্ত পুরুষের প্রকান্ড উষ্ণ বুকের মধ্যে চলে এল। গর্জমান এক কামুক পুরুষ যার শিরা-উপশিরায় প্রাণস্রোত, যার আদরে অবহেলায় সর্বক্ষণ জীবন বয়ে যাচ্ছে। সেই প্রথম পুরুষটির আদরে লজ্জায় চোখ বুজেছিল বুঝি হাসি। চোখ আর খোলা হল না। কলকাতা তার চারদিকে সর্বক্ষণ এক শিশু বয়সের বিস্মৃত রঙিন মেলার মতো কাল্পনিক হয়ে রইল।