এ সব গোলমাল মিটলে বাড়িটা একটু ঠান্ডা হল। ভৈরবকাকার বদলে আজ দাদা বাজার করে এনেছে। ফলে রান্নাঘরে আমরা সবাই ব্যস্ত। এক প্রস্থ জলখাবার হবে, সেই সঙ্গে বাবার আর দাদার অফিসের ভাতও।
জলখাবারের চচ্চড়ির আলু ধুতে গিয়ে কুয়োর পাড়ে দেখি, চিনি বাড়ির মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়তে পড়তে উঠে এসে পুতুল স্নান করাচ্ছে।
বললাম, অ্যাই, মাস্টারমশাই বসে আছেন না?
ছোড়দার অঙ্ক দেখছেন তো!
তা বলে তুই এই সাতসকালে পুতুল খেলবি? যা।
সে গুটি-গুটি চলে যায়। ওর সোয়েটারটা গেছে আমার দোষেই। সামনের শীতের জন্য প্যাটার্ন তুলতে ওটা নিয়েছিল লিচু। কালই ফেরত দিয়ে গেছে। আলিস্যির জন্য আমি ওটা তুলে না রেখে ঠাকুমার ঘরে আলনায় ঝুলিয়ে রেখেছিলাম।
কালও কই হারমোনিয়ামটা নিয়ে একটা কথাও তো বলেনি লিচু। আচ্ছা সেয়ানা মেয়ে যা হোক। ওদের বাড়িতে কখনও গান তুলতে গেলে ওই হারমোনিয়াম দেখলেই আমার হাসি পায়। মাগনা দিলেও নেওয়ার নয়। পাগলা দাশুকে খুব জক দিয়েছে ওরা।
গোমড়ামুখো দাদা কুয়োর পাড়ে এসে সিগারেট ধরাচ্ছে। বাথরুমে যাবে। দেশলাইটা কুয়োর কার্নিশে রেখে বলল, ঘরে নিয়ে যাস তো। নইলে কাক ঠোঁটে করে তুলে পালায়।
পাগলা দাশুকে চিনিস দাদা?
কোন পাগলা দাশু?
মল্লিকদের বাড়িতে যে এসেছে।
ও, অসিতের ভাই। পাগলা নয় তো। পাগলা হতে যাবে কেন?
কথাটা তুলেই আমার লজ্জা করছিল। ব্যাপারটা এত অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু ওই হারমোনিয়াম কেনার কথাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না যে! লিচুরা আচ্ছা ছোটলোক তো! কী বলতে ওই অখাদ্য হারমোনিয়ামটার জন্য দুশো টাকা নিল?
বাইরের ঘরে একটা বাজখাই গলা শুনে কুয়োতলা থেকেও বুঝতে পারলাম, মল্লিকবুড়ো অর্থাৎ আমার হবু শ্বশুর এসেছেন। চোর আসার খবর পেয়েই আসছে সবাই।
চচ্চড়ির আলু ধুয়ে রান্নাঘরে যেতেই মা বলল, বীরেনবাবুর চা-টা তুই-ই কর।
বীরেনবাবু অর্থাৎ মল্লিকবুড়োর চায়ে বায়নাক্কা আছে। দুধ বা চিনি চলবে না, লিকারে শুধু পাতিনেবুর রস মেশাতে হবে তাও টক চা হলে চলবে না। লিকারে শুধু একটু গন্ধ হবে।
আমি বাগানে পাতিলেবু আনতে যাওয়ার সময় বৈঠকখানার দরজায় পরদার আড়ালে পঁড়িয়ে শুনতে পেলাম মল্লিকবুড়ো বলছেন, শেষ রাতে তো শুনলাম আমার বাগানেও চোর ঢুকেছিল। আমার ভাইপো কানু দেখেছে, ছুকরি একটা চোর বেলফুল তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সাড়াশব্দ পেয়ে পালিয়ে যায়।
বাবা বললেন, ও। সে তো ফুলচোর!
আমি রাঙা হয়ে উঠলাম লজ্জায়।
০৩. পাগলা দাশু
দুনিয়ার কোনও কাজই বড় সহজ নয়। গান শেখা, সাইকেলে চড়া বা পাহাড়ে ওঠা। সহজ সুরের রামপ্রসাদী আমায় দাও মা তবিলদারি গানটা কতবার গলায় খেলানোর চেষ্টা করলাম। কিছুতেই হল না। অথচ সুরটা কানে যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। সহজ, অতি সহজ গান। কিন্তু আমার কান শুনলেও গলা সেই সুর মোটেই শুনতে পাচ্ছে না। যে সুরটা কানে বাজছে কিন্তু গলায় আসছে না তাকে গলায় আনতে গেলে কী করা দরকার তা জানবার জন্য আমি সিভিল হাসপাতালের ই এন টি স্পেশালিস্টের কাছে একদিন হানা দিলাম।
খুবই ভিড় ছিল আউটডোরে। ঘণ্টা দেড়েকের চেষ্টায় অবশেষে তার চেম্বারে ঢুকতে পেরেছি। নমস্কার ডাক্তারবাবু।
নমস্কার। বলুন তো কী হয়েছে?
আমার কানের সঙ্গে গলার কোনও সমঝোতা হচ্ছে না।
তার মানে কী?
অর্থাৎ কানে যে গানটা শুনতে পাচ্ছি, কিছুতেই সেটা গলায় তুলতে পারছি না।
আপনি কি গায়ক?
না, তবে চেষ্টা করছি।
হাঁ করুন।
করলাম হাঁ। মস্ত হাঁ। ডাক্তার গলা দেখলেন, কপালে আটা গোল একটা আয়না থেকে আলো ফেলে নাক এবং কানও তদন্ত করলেন। তারপর মস্ত একটা খাস ছেড়ে বললেন, হুঁ।
ডিফেক্টটা ধরতে পারলেন?
ডান কানে একটা তেকোনা হাড় উঁচু হয়ে আছে। নাকের চ্যানেলে ভাঙা হাড় আর পলিপাস। গলায় ফ্যারিনজাইটিস। সব ক’টারই ট্রিটমেন্ট দরকার। নাক আর কান দুটোই অপারেশন করালে ভাল হয়।
আমি অবাক হয়ে বললাম, এত কিছুর পর গান গলায় আসবে?
আশা তো করি। বলে ডাক্তার মৃদু হাসলেন। চাপা স্বরে বললেন, এ সব কি হাসপাতালে হয়? বিকেলের দিকে আমার হাকিমপাড়ার বাসায় যে চেম্বার আছে সেখানে চলে আসবেন।
আমি চলে আসি।
.
আমার গলায় যে সুর খেলছে না সেটা আমাকে প্রথম ধরে দেয় পশুপতি। লিচুর মা কিন্তু রোজই ভরসা দিচ্ছেন যে, একটু-একটু করে আমার হচ্ছে। একদিন মা লাগাতে পারছি অন্যদিন রে-ও লাগছে।
পশুপতি আমার ওপর খুবই রেগে ছিল। হারমোনিয়াম কেনার পর দু দিন আমার সঙ্গে দেখা করেনি। তিন দিনের দিন এসে ফালতু কথা ছেড়ে সহজ ভাষায় বলল, আপনার মতো আহাম্মক দেখিনি। ওই গদা মালের জন্য কেউ দুশো টাকা দেয়? টাকা কি ফ্যালনা নাকি?
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, পশুপতি, কোন জিনিসের আসলে কী দাম তা তুমিও জানোনা আমিও জানি না। ঠকেছি না জিতেছি সে বিচারও বড় সহজ নয়।
আর আমি যে একশো টাকার খদ্দের ঠিক করে রেখেছি তার কী হবে? সে রোজ তাগাদা দিচ্ছে। আমি তো আপনাকে পইপই করে বলে রেখেছিলাম পঁচাত্তর টাকার ওপরে উঠবেন না। আপনি মাল না চিনলেও আমি তো চিনি।
এ কথার কোনও জবাব হয় না। পশুপতিকে কী করে বোঝানো যাবে যে, লিচুদের বাড়িতে সেদিন এক মোহময় বিকেল এসেছিল। ছিল কনে দেখা আলো, ফুলের গন্ধ, হারমোনিয়ামের একাকিত্ব। মন বলছিল, কনে কই? কনে কই? সেই সময়ে কেউ টাকার কথা বলতে পারে? আমি তবু দুশো টাকা বলেছিলাম। এবং বলেই মনে হয়েছিল খুব কম বলা হয়ে গেল। লিচু, লিচুর মা বাবা বোন অবশ্য খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল। হতভম্ব হয়ে গেল পশুপতিও। কিন্তু ওই দামের নীচে সেদিন যে হারমোনিয়ামটা কেনা ঠিক হত না তা কেউ বুঝবে না।