ঠাকুমা তো বুঝতে পারেনি কেন বাঁটুল চিমটি কেটেছে। ফলে ঠাকুমা উঃ বলে জেগে উঠে বাটুলকে বকে উঠেছে, এ ছেলেটার সঙ্গে শোওয়াই যায় না। এই হাঁটু দিয়ে গুতোচ্ছে, এই গায়ে পা তুলে দিচ্ছে, এই দাঁত কড়মড় করছে, এখন আবার চিমটিও দিতে শুরু করেছে।
সাড়াশব্দে বাইরের ঘরে ভৈরবকাকা জেগে উঠে গম্ভীর গলায় বলল, কে রে?
চোর কি আর তখন ত্রিসীমানায় থাকে? চোর ধরতে হলে কখনও আওয়াজ দিতে নেই। নিঃশব্দে উঠে গিয়ে নাকি হঠাৎ সাপটে ধরতে হয়। কিন্তু সে সাহস এ বাড়ির কারও আছে বলে মনে হয় না। তবে মাঝরাতে বেশ একটা হই-হই হল আমাদের বাড়িতে। বাঁটুল চোর কথাটা উচ্চারণের সঙ্গে-সঙ্গে প্রথমে ঠাকুমা, তারপর ভৈরবকাকা এবং তারপর ঘুম ভেঙে বাড়ির প্রায় সবাই আতঙ্কে বিকট গলায় চোর! চোর! চোর! চোর! করে চেঁচাতে লাগল। কিন্তু কেউ দরজা খুলে বেরোয় না। পাড়ার লোক যখন জড়ো হল তখন চোর তার বাড়িতে গিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুম দিচ্ছে।
কিন্তু আমরা বাড়িসুদ্ধ লোক সেই যে জেগে গেলাম তারপর আর সহজে কেউ ঘুমাতে গেল না। আলনা থেকে ঠাকুমার থানধুতি ছাড়া চিনির একটা সোয়েটার আর ভৈরবকাকার একটা পুরনো পাজামা চুরি গেছে। পুরনো পাজামাটার জন্য দুঃখের কিছু নেই, ওটা ঠাকুমা ন্যাতা করবে বলে এনে রেখেছিল। কিন্তু তবু এই চুরি উপলক্ষ করেই বাড়িতে মাঝরাতে সিরিয়াস আলোচনাসভা বসে গেল। এমনকী এক রাউন্ড চা পর্যন্ত হয়ে গেল। সেই চা করতে রান্নাঘরে যেতে হল আমাকেই, সঙ্গে অবশ্য পিসি গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ভৈরবকা বললেন, চোরেদের নিয়ম হল, চুরি করে গেরস্তবাড়িতে পায়খানা করে যায়।
বাবা বললেন, দূর! ও সব সেকেলে চোরদের নিয়ম।
তবু দেখা যাক।
বলে ভৈরবকাকা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ আর বিরাট লাঠি হাতে বেরোলেন। সঙ্গে আমাকে আর বাঁটুলকে নিলেন। বললেন, আমার চোখ তো আর অত বেশি তেজি নয়। তোরা একটু নজর করতে পারবি।
ভয়ে আমার হাত পা হিম হয়ে আসছিল। বাটুল তার এয়ারগান বগলদাবা করে আমাকে ভরসা দিয়ে বলল, কোনও ভয় নেই রে মেজদি, এয়ারগানের সামনে পড়লে চোরকে উড়িয়ে দেব।
আমি বললাম, হু! খুব বীর।
টর্চ জ্বেলে ভিতরের মস্ত উঠোন আর বাইরের বাগান খুঁজে দেখা হল। কোথাও সে রকম কিছু পাওয়া গেল না।
তখন ভোর হয়ে আসছে। ভৈরবকাকা বললেন, আর শুয়ে কাজ নেই। চল, মর্নিং ওয়াকটা সেরে আসি।
বেড়িয়ে ফেরার পথে মল্লিকদের বাড়ির বাগানে অনেক বেলফুল দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। ওদের বাড়িতে কুকুর নেই। তাই নিশ্চিন্তে ফটক খুলে ঢুকে এক কোঁচড় বেলকুঁড়ি তুলে ফেললাম। ভিজে ন্যাকড়ায় ঢাকা দিয়ে রাখলে বিকেলে ফুটে মউ মউ করবে গন্ধে। ফুল তুলছি আপনমনে, এমন সময় হঠাৎ বাড়ির ভিতর থেকে একটা বিদঘুঁটে হারমোনিয়ামের শব্দ উঠল। খুব অবাক হয়েছি। এ বাড়িতে গানাদার কেউ নেই হারমোনিয়ামও নেই জানি। তবে?
সারেগামার কোনও রিডেই সুর লাগছে না। সেই সঙ্গে আচমকা একজন পুরুষের গলা বেসুরে মা ধরল। এমন হাসি পেয়েছিল, কী বলব!
ভৈরবকাকা কাকভোরে জাম্বুবানের মতো ফটকের বাইরে লাঠি আর টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে। হারমোনিয়াম শুনে তিনি বললেন, কাটুসোনা, চলে আয়। বাঁটুল ফুল চুরিতে আগ্রহী নয় বলে একটু এগিয়ে গেছে।
এ বাড়িতে ফুল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লেও আমার ভয় নেই। বলতে কী এ বাড়িতে আমার কিছু অধিকারও আছে। এ বাড়ির ছোট ছেলে অমিতের সঙ্গে বহুকাল হল আমার বিয়ের কথা ঠিকঠাক। সে আমেরিকা থেকে এক ফাঁকে এসে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। আমিও তৈরি।
ভৈরবকাকা অবশ্য ফুল চুরির ব্যাপারটা পছন্দ করছেন না। কারণ হবু বউ ভাবী শ্বশুরবাড়িতে ফুল চুরি করতে এসে ধরা পড়লে ব্যাপারটা যদি কেঁচে যায়। তাই উনি তাড়া দিয়ে বললেন, সব জেগে পড়েছে। পালিয়ে আয়। অত ফুল তোর কোন কাজে লাগবে শুনি?
মনে মনে বললাম, মালা গাঁথব।
মুখে বললাম, একটু দাঁড়াও না। এ বাড়িতে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে কে?
কে জানে! তবে ওদের একটা মাথা-পাগলা গোছের ভাই এসেছে কলকাতা থেকে শুনেছি। সে-ই বোধ হয়।
কী রকম ভাই?
সে কত রকম হতে পারে। পিসতুতো, মাসতুতো, খুড়তুতো, জ্ঞাতির কি শেষ আছে! কে জানে?
আমি খুশি হতে পারি না।
হারমোনিয়ামটা তারস্বরে বিকট আওয়াজ ছাড়ছে। সঙ্গে গলাটা যাচ্ছে সম্পূর্ণ অন্য সুরে। যাকে বলে বেসুরের সঙ্গে বেসুরের লড়াই।
আমি কোঁচড় ভরতি ফুল নিয়ে চলে আসি। ভৈরবকাকাকে জিজ্ঞেস করি, তুমি দেখেছ লোকটাকে?
লোকটা নয়, ছেলেটা। একেবারে পুঁচকে ছোকরা। টাউন ডেভেলপমেন্টের চাকরি নিয়ে এসেছে। কিছু দিন হল। সে দিন দেখি প্রকাণ্ড একটা পাকা কাঁঠাল নিয়ে বাজার থেকে ফিরছে। পিছনে-পিছনে দুটো গোরু তাড়া করাতে মালগুদামের রাস্তা দিয়ে দৌড় দিচ্ছিল। তাই দেখে সকলে কী হাসাহাসি।
মল্লিকবাড়ি এখন অবশ্য ফাঁকাই থাকে। ছেলেরা সবাই বিদেশ-বিভুয়ে চাকরি করে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। থাকার মধ্যে বুড়ো আর বুড়ি। অবশ্য বুড়োবুড়ি বলতে সাঙ্ঘাতিক বুড়োবুড়ি তারা নন। আমার হবু শাশুড়ির চেহারায় এখনও যৌবনের ঢল আছে। হবু শ্বশুরমশাই এখনও বাহান্ন ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে দিনে চার মাইল করে হেঁটে আসেন। দরকার হলে সাইকেলও চালান।