পিছন থেকে বাচ্চার মা ডাকছে, চলে এসো! কী বোকার মতো হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছ ওখানে?
বাচ্চার বাবা চমকে ওঠে। তারপর সাবধানে রক্তের পুকুরটা ডিঙিয়ে বাচ্চার মায়ের কাছে যায়। তারপর তারা বোধ হয় ফিরে গেল তাদের বাচ্চাটার কাছে। যাবেই তো! বাচ্চাটা ভীষণ কাঁদছে।
ট্রেন হুইসিল দিচ্ছে বার বার। কুক বুক কু-উ। কুক কুক কুউ! থেমে আসছে গাড়ি। দু’ দিকের দরজা খুলে যায়। চারটে লোক নেমে গেল।
আমার গলা দিয়ে ঘরর ঘরর করে একটা শব্দ হয়। জিভে সামান্য ফেনা। ধোঁয়াটে চোখেও আমি দেখতে পাই, মুখের ফেনার রং লাল।
হঠাৎ কামরায় তুমুল হট্টরোল ফেটে পড়ল। কারা চেঁচাচ্ছে, খুন! খুন! ডাকাত! বাঁচাও! খুবই ক্ষীণ শোনায় সেই শব্দ। আমার কানে ঝি ঝি ডাকছে। ঘন, তীব্র, একটানা।
কয়েকজন আমাকে তুলছে মেঝে থেকে। চোখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। লাভ নেই।
সায়ন!
তুমি আমার কেউ না।
আঃ সায়ন!
আমি তোমাকে ভুলে গেছি।
উঃ সায়ন।
ছবিটা ফেরত দেবে? আমাদের জোড়া ছবি কারও হাতে পড়লে কী ভাববে বলো তো! তুমি বেঁচে থাকলে এক কথা ছিল। তা যখন হচ্ছে না তখন কেন ওটা রাখবে? দাও নষ্ট করে ফেলি।
আমি ওর কথার যুক্তিযুক্ততা বুঝতে পারি। ছবিটা বের করে ওর হাতে দিই। ও বসে বসে ছিঁড়তে থাকে।
লিচু।
ওঃ দারুণ মজা! দারুণ মজা!
কেন লিচু?
দেখুন, কত বার হাতবদল হয়ে আমাদের হারমোনিয়াম আবার আমাদের কাছে ফিরে এসেছে।
খুশি ত লিচু?
ভীষণ। হারমোনিয়াম থাকলে আর কিছু চাই না। ঘর না, বর না, টাকা পয়সা না।
একদিন জ্যোৎস্নারাতে তুমি কিন্তু আমাকে চেয়েছিলে লিচু!
উঃ!–লিচু লজ্জায় মুখ ঢাকে। বলে, তা ঠিক। তবে গরিবরা সব সময়ই এটা চায়, ওটা চায়। না পেলেও দুঃখ হয় না আমাদের। আপনি কিছু ভাববেন না। হারমোনিয়াম আমাকে সব ভুলিয়ে দেবে।
শিয়রের জানালায় ফুলচোর ডাক দেয়, শুনছেন!
ফুলচোর!
কলকাতায় কী হল?
সে অনেক কথা।
ম্লান মুখে বিষণ্ণ গলায় ফুলচোর বলল, আমাকে চিনতে পারলেন শেষমেষ?
না, ফুলচোর।
বললেন যে সেদিন।
ওটা মিথ্যে কথা। আপনি তো কোনওদিন কলকাতায় যাননি।
ফুলচোর জানালার গ্রিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে, আপনি সব জানেন, আপনি সব জানেন। এখন আমার কী হবে?
কিছু হবে না। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলি, আমি কাউকে বলিনি। কোনওদিন বলব না। ভুলে যাব। দেখবেন।
ফুলচোর চোখের জল মুছে হাসে, আমি জানতাম, আপনি কখনও অত নিষ্ঠুর হতে পারেন না। আপনার মন বড় সুন্দর। লিচুদের হারমোনিয়ামটা নইলে আপনি কিনতেন না।
পশুপতিকে বলবেন লিচুদের হারমোনিয়ামটা যেন দিয়ে দেয়।
বলব।
এই জানলাটা এখন কি খুব ফাঁকা লাগবে আপনার?
ওমা! লাগবেনা? আমি তো রোজ আসি। যখন আপনি ছিলেন না তখনও। ফাঁকা জানলায় একা একা কত কথা কয়ে যাই।
ফাজিল।
ফুলচোর তাকায়। চোখে করুণ দৃষ্টি।
কোনওদিন বোঝেননি আপনি বলতে বলতে ফুলচোরের সুন্দর ঠোঁটজোড়া কেঁপে ওঠে।
কী বুঝব?
আমি বুঝি শুধু আপনার সেই আমাকে মনে পড়ার ভয়ে আসতাম?
তবে?
আমি আসতাম ফুল তুলতে। স্বাচ্ছন্নের মতো বলে ফুলচোর।
আমি চেয়ে থাকি। বুকের মধ্যে ডুগডুগির শব্দ।
ফুলচোর অকপটে চেয়ে থেকে বলে, একটা সাদা ফুল। ছোট্ট, সুন্দর।
ফাজিল।
দেবেন সেই ফুলটা আজ? দিন না!
ফুলচোর হাত বাড়ায়। গভীর গাঢ় স্বরে বলে, সাদা সুন্দর ফুলের মতো ওই হৃদয়। দেবেন?
আমি চোখ মেলি। হাসপাতালের ঘর নয়? তাই হবে। উপুড় করা রক্তের বোতল থেকে শিরায় ড্রিপ নেমে আসছে। নাকে নল।
একটা কালো ঢেউ আসে।
কে যেন চেঁচিয়ে বলছে, গাড়ি বদল! গাড়ি বদল!
মাঝরাতে অন্ধকার এক জংশনে গাড়ি থেকে নামি। ঘোর অন্ধকার প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে ওপাশে এক অন্ধকার ট্রেনের কামরায় গিয়ে উঠি। একা।
জানলার ধারে ঠেস দিয়ে আরাম করে বসে থাকি।
ট্রেন ছাড়ে। দুলে দুলে চলে। কোথায় যাচ্ছি তা প্রশ্ন করতে নেই। কেউ জবাব দেবে না।
তা ছাড়া কোথায় যাচ্ছি তা তো আমি জানি।
কিন্তু জানালায় তবু ফুলচোরের মুখ ভেসে আসে। করুণ, তীব্র এক স্বরে সে বলে, পৃথিবী আর সুন্দর থাকবে না যে। ফুল ফুটবে না আর! ভোর আসবে না। আপনি যাবেন না, আমাকে দয়া করুন।
আপনাকে দয়া, ফুলচোর? হাসালেন!
কেন যাচ্ছেন? কেন যাচ্ছেন? আমাদের কাছে থাকতে আপনার একটুও ইচ্ছে করে না?
আমি একটু হাসবার চেষ্টা করি। বলি, বড় মারে এরা। বড় ভুল বোঝে। প্রত্যাখ্যান করে। তার চেয়ে এই লম্বা ঘুমই ভাল। অনেক দিন ধরে আমি এই রকম ঘুমিয়ে পড়তে চাইছি ফুলচোর।
আমি যে রোজ একটা ফুলই তুলতে আসতাম তা কি জানেন?
জানি।
আজও সেই ফুল ভোলা হল না আমার। পৃথিবীতে তো সেই ফুল আর ফুটবে না কোনও দিন। প্লিজ!!
আমি ক্লান্ত বোধ করি। বলি, আপনি বাগদত্তা, ফুলচোর।
খুব জানেন। বোকা কোথাকার।
নন?
নই।
আর সায়ন?
পৃথিবীতে আর কেউ আমার মতো অপেক্ষা করছে না আপনার জন্য। শুধু আমি। শুধু একা আমি।
কেন ফুলচোর?
ওই সুন্দর সাদা ছোট্ট ফুল, ওটা আমার চাই।
আস্তে আস্তে গাড়ি থামে। পিছু হটে। আবার জংশন। আবার গাড়িবদল।
চোখের পাতায় হিমালয়ের ভার। তবু আমি আস্তে আস্তে চোখ মেলে চাই।