উ!
আপনার জলের ফ্লাস্কটা একটু নেব? আমাদেরটায় জল নেই।
নিন না। ওই তো রয়েছে।
বলে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়তে থাকি। ঘুমচোখে অস্পষ্ট দেখতে পাই, আমার ফ্লাস্ক খুলে নীচের সিটে একটা বাচ্চা ছেলেকে চুকচুক করে জল খাওয়াচ্ছে তার মা, আর তার বাবা মুগ্ধ চোখে দৃশ্যটা দেখছে।
আহা, দৃশ্যটা বড় সুন্দর। দেখতে দেখতে আমি ঘুমে ঢলে পড়ি। কাল আমি আবার সেই মহান পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে পাব। অন্ধকারে হঠাৎ জাহাজের মতো ভেসে ওঠ ভোরের পাহাড়, ব্রোঞ্জের রং ধরে। ব্রোঞ্জ ক্রমে সোনা হয়।
কাকভোরে ফুলচোর আসবে ঠিক। ডাকবে, শুনছেন!
আপনার ঘড়িটা! ও মশাই!
আমি ঘুমের টিকিট আঁটা চোখ খুলে বলি, উ।
ঘড়িটা দিয়ে দিন।
আমি বাঁ হাতের ঘড়িটা খুলে লোকটার হাতে দিয়ে দিই। চোখ বুজেই দেখি, পাহাড়ের গায়ে সেই পাথরটায় বসে আছি। ঘন্টানাড়া একটা পাখি ডাকছে। ঝোরার শব্দ।
পেটে একটা খোঁচা লাগে। ককিয়ে উঠে আবার চোখ মেলি। প্রবল হাহাকারের শব্দ তুলে উন্মত্ত ট্রেন ছুটছে। প্রচণ্ড তার দুলুনি। মুখের সামনে আর একটা কাঠখোট্টা মুখ ঝুঁকে আছে।
আপনার মানিব্যাগটা?
হিপ পকেট থেকে মানিব্যাগটা ঘুমন্ত হাতে বের করে দিয়ে দিই। তারপর ঘুমে তলিয়ে যাই আবার। ঘুমের মধ্যে লিচুদের হারমোনিয়ামটা প্যা-পোঁ করে বাজতে থাকে। বারবার বাজে। বেজে বেজে বলে, সখি ভালবাসা কারে কয়, সে কি শুধুই যাতনাময়…
কে যেন একটা লোক বিকট চেঁচিয়ে বলছে, শব্দ করলে জানে মেরে দেব! চোপ শালা! জানে মেরে দেব! কেউ শব্দ করবে না। জান নিয়ে নেব।
ফের আমাকে কে যেন ধাক্কা দেয়, আর কী আছে? ও মশাই আর কী আছে?
কে যেন কাকে একটা ঘুসি বা লাথি মারল পাশের কিউবিকলে। বাবা রে!’ বলে ককিয়ে উঠে। একটা লোক পড়ে যায়। তারপর ভয়ে বীভৎস রকমের বিকৃত গলায় বলে, মেরো না! মেরো না! দিচ্ছি।
আর একটা শব্দ করলে মাল ভরে দেব! চোপ শুয়োরের বাচ্চা।
একটা হাত আমার কোমর, পকেট, জামার নীচে হাতড়াচ্ছে। আমি চোখ মেলে চাইতেই মুখের সামনেকার হলুদ আলোটা কটকট করে চোখে লাগল।
কী চাই? আমি কাঠখোট্টা মুখটার দিকে তাকিয়ে বললাম।
আর কী আছে?
আমি চোখ বুজে বলি, কিছু নেই।
হয়তো আবার ঘুমের ঝোঁক এসেছিল। আবার কে যেন ডাকল, শুনছেন?
ফুলচোর। আমি মাথা তুলে শিয়রের জানলাটা দেখতে চেষ্টা করি।
শুনছেন! শুনছেন।–খুব চাপা জরুরি গলায় আমাকে ডাকছে কেউ। নীচের সিটে একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল।
শুনুন না। শুনছেন না কেন? বলতে বলতে কেঁদে ওঠেন একজন মহিলা।
আমি চোখ চাই।
কী হয়েছে?
সেই বাচ্চার মা মুখ তুলে চেয়ে আছে আমার দিকে। মুখে আতঙ্ক, চোখে জল।
ওরা আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেল বাথরুমের দিকে। কী হবে?
কারা?– আমি বিরক্তির গলায় বলি।
ডাকাতরা। এতক্ষণ ধরে কী কাণ্ড করল টের পাননি? প্লিজ। কেউ কিছু বলছে না ওদের।
শুনতে শুনতেই আমি নেমে পড়তে থাকি বাংক থেকে।
আপনার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেল কেন?
বাচ্চার হাত থেকে বালা নিতে চেয়েছিল, আমার হাজব্যান্ড নিতে দিচ্ছিল না। ওই শুনুন।
বাথরুমের দিক থেকে একটা কান ফাটানো আওয়াজ আসে। বোধ হয় চড়ের আওয়াজ।
কামরার সব লোক চোখ চেয়ে স্ট্যাচুর মতো বসে আছে। নড়ছে না।
আমি বরাবর দেখেছি, আমি কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই আমার শরীর তার কাজে নেমে পড়ে। এ দুইয়ের মধ্যে বোধ হয় একটা যোগাযোগের অভাব আছে।
বাথরুমের গলিতে অল্প আলোয় একটা লোককে গাড়ির দেয়ালে ঠেসে ধরে আছে চার মস্তান। হাতে ছোরা, রিভলভারও।
একবার দু’বার মার খাওয়ার পর আর মারের ভয় থাকে না। আমার ভয় অবশ্য প্রথম থেকেই ছিল না। আমি বহুবার মার খেয়েছি। আমার মাথার একটা অংশ বোধ হয় আজও ফাঁকা।
আমি কিছু ভাবি না। পিছন থেকে চুল ধেরে দুটো লোককে সরিয়ে দিই তাঁচকা টান মেরে। রিভলবারওয়ালা ফিরে দাঁড়াতে না পাড়াতেই আমার লাথি জমে যায় তার পেটে।
কমিকসের বীরপুরুষরা একাই কত লোককে ঘায়েল করে দেয়। জেমস বন্ড আরও কত বিপজ্জনক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে বেরিয়ে আসতে পারে। সিনেমার হিয়োরা অবিরল ক্লান্তিহীন মারপিট করে যেতে পারে।
হায়! আমি তাদের মতো নই।
তবু প্রথম ঝটকায় ভারী চমৎকার কাজ হয়ে যায়। একটা লোক বসে কোঁকাচ্ছে, বাকি তিনটে ভ্যাবাচ্যাকা। কিন্তু সেটা পলকের জন্য মাত্র।
আমি আর একবার হাত তুলেছিলাম। সে হাত কোথাও পৌঁছোয় না। একজন চাপা ভয়ংকর গলায় বলল, ছেড়ে দে। আমি দেখছি।
পিঠের দিক থেকে একটা ধাক্কা খাই। একবার, দু’বার।
ধাক্কাগুলো সাধারণ নয়। কেমন যেন অদ্ভুত ধরনের। পেটটা গুলিয়ে ওঠে। মাথাটা চক্কর মারতে থাকে।
কে যেন বলল, আর একটু ওপরে আর একবার চালা!
চালাল। তৃতীয়বার ছড়াৎ করে খানিকটা রক্ত ছিটকে আসে সামনের দিকে।
আমি মুখ তুলি। দেয়ালে ঠেস দেওয়া বাচ্চার বাবা আমার দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে আছে।
আমি তাকেই জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে আমার?
লোকটা হতভম্বের মতো মাথা নেড়ে জানাল, না।
আমি অবাক হই। কিছু হয়নি? তবে আমার দুটো হাতের আঙুল কেন কুঁকড়ে আসে? কেন উঠতে পারছি না? পায়ের কাছে কেন এক পুকুর রক্ত জমা হচ্ছে?
চারটে লোক সরে যায় দু’দিকে দরজার কাছে। উপুড় হয়ে আমি বসে আছি। কিন্তু বসে থাকতে পারছি না। বড় ঘুম। বমি পাচ্ছে। শরীরটা চমকে চমকে উঠছে।