একদিন মৃদু মোলায়েম স্বরে বলে ফেলি, চুরি করতে নয়, আমি আজকাল ধরা দিতে আসি।
ঠাট্টা করছেন?
কেন, আমি সব সময়ে কি শুধু ঠাট্টাই করি? আমার মন বলে কিছু নেই?
ফাজিল মেয়েরা কতভাবে পুরুষকে নাচায়।
আপনি আর নাচছেন কই?
আমার কথা আলাদা। আমি আর স্বাভাবিক নই। কিছু মনে পড়ছে না। যতদিন না সব ঠিকঠাক মনে পড়ে, ততদিন আমি আর স্বাভাবিক নই।
মনে করতেই হবে এমন কোনও কথা নেই। খামোকা চেষ্টা করছে কেন? ওতে মাথা আরও গুলিয়ে যায়।
পাগলা দাশু ইদানিং বড় অস্থির, দু হাতে মাথার চুল খামচে বড় বড় আনমনা চোখে দূরের অন্ধকার পাহাড়ের দিকে চেয়ে থাকে। বলে, মানুষ আসলে কিছুই ভোলে না, সব তার মস্তিষ্কের কোষে সাজানো থাকে থরে থরে। কিন্তু সব কথা সে মনে রাখতে চায় না। কিছু ঘটনাকে সে বাতিল করে দেয়, ভুলতে চায়। তাই ভুলে যায়। কিন্তু আমি কেন ভুলতে চাইছি?
আমি কথাটা ঘুরিয়ে দিই। জিজ্ঞেস করি, আপনি কলকাতায় কবে কেন?
শিগগিরই যাব। অফিস ছুটি দিতে চাইছে না। যেদিন দেবে সেদিনই রওনা হব।
সায়ন্তনী আপনাকে চিঠি দেয় না?
দেয়। খুব ভাল চিঠি লেখে সায়ন্তনী।
আপনাদের বিয়ে কবে?
আসছে শীতে।
আমি করুণ মুখ করে বলি, আপনি কলকাতায় গেলে এই জানলাটা আমার কাছে একদম ফাঁকা লাগবে ক’দিন।
পাগলা দাশু হাসে। বলে, চিরকালের জন্যও ফাঁকা লাগতে পারে, আমি কলকাতায় লি চেয়ে দরখাস্ত করেছি।
শুনে আমার মনে খুশির জোয়ার এল। জানলার গ্রিল প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে প্রায় চেঁচিয়ে বলে ফেলি, কবে?
পাগলা দাশু একটু যেন অবাক হয় আমার উৎসাহ দ্যাখে, বলে কে জানে! হয়তো হবেই না, ইনএফিসিয়েন্সি আর ডিসওবিডিয়েন্স-এর জন্য আমাকে কলকাতা থেকে ট্রানসফার করা হয়েছিল, ওরা আমাকে হয়তো ফেরত নেবেনা।
আমি নিভে যাই। বলি, ও
খুশি হলেন না তো!
আমি আবার কথা ঘোরানোর জন্য বলি, সায়ন্তনী আনাকে চিঠিতে কী লেখে?
কী আর লিখবে? আমরা প্রায় ছেলেবেলা থেকে দুজনে দুজনকে ভালবাসি। তাই দু’জনের মধ্যে নতুন কথা তো কিছু নেই। আমাকে ও ভাল থাকতে লেখে, সাবধানে চলতে বলে, মন দিয়ে চাকরি করতে কম দেয়, ঠিক প্রেমের চিঠি নয়। কিন্তু ভাল চিঠি।
সায়নী আপনাকে কখনও সন্দেহ করে না?
না, কেন করবে?আমি তো অবিশ্বাসের কিছু করিনি!–বলেই হঠাৎ থমকে যায় পাগলা দাশু। সঙ্গে সঙ্গে বলে, না, করেছি, নিশ্চয়ই করেছি। নইলে আমি ভুলতে চাইছি কেন?
আমিও অনেক কিছু ভুলে যেতে চাই। আপনার মতো যদি ভুলতে পারতাম।
কী ভুলতে চান আপনি?
ধরুন এই জানলাটা, এই বাগান, এই কয়েকটা ভোরবেলার কথা। সবচেয়ে বেশি ভুলতে চাই আপনাকে।
ফাজিল।-বলে মুখ ঘুরিয়ে নেয় পাগলা দাশু।
আমি গভীর স্বরে বলি, সত্যি। বিশ্বাস ফুলচোর, এটা ইয়ারকির কথা নয়। আমার সমস্যা অনেক জটিল।
আমি অভিমান করে বলি, লিচুর জন্য আপনার যে দরদ সেটুকুও কি আমার জন্য নেই?
পাগলা দাশু কেমন যেন ভ্যাবলা হয়ে যায়, হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে অন্ধকারের দিকে। তারপর একটু হেসে বলে, লিচু আপনার মতো ফাজিল নয়।
আমি অভিমানের সুরটা বজায় রেখে বলি, এ বাগানে সাপ আছে পোকামাকড় আছে। এই অন্ধকার ভোরে সাপখোপের ভয়কে তুচ্ছ করে শুধু ফাজলামির জন্য কেউ আসে?
ইচ্ছে হয় বলি, রাধা কি কৃষ্ণের কাছে ফাজলামি করতে যেত? কিন্তু সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বলে, আর পাগলা দাশু সেটাকে আরও ফাজলামি ভাববে বলে চেপে যাই।
পাগলা দাশু সাপের কথায় ভয় পেয়ে বলল, একটা টর্চ নিয়ে আসতে পারেন না!
ও বাবা! ‘তা হলে দরদও তো আছে দেখছি।
আছে। বোধ হয় আছে। কিন্তু আমি জানি আপনি অভিসারে মোটেই আসেন না ফুলচোর, আপনার অন্য কোনও মতলব আছে।
কী করে বুঝলেন?
আপনার মুখ অনেক কথা বলে, চোখ বলে না, আপনি আমাকে জ্বালাতে আসেন। আজও তাই আমাকে আপনার নামটাও বলেননি।
আমার নাম কৃষ্ণা।
হতে পারে। নাও হতে পারে।
বিশ্বাস হয় না আমাকে?
না। কী করে বোঝাই বলুন তো!
এ সব বোঝাতে হয় না ফুলচোর। আপনা থেকেই বোঝা যায়।
ভোর হয়ে আসে। আমি পালিয়ে আসি।
খেলাটা খুবই বিপজ্জনক, এই মফসসল শহরে একবার যদি পাগলা দাশুর সঙ্গে আমার জানালার আজ্ঞার কথা লোকে জেনে যায় তবে সারা শহরে ঢি ঢি পড়ে যাবে। এ তো কলকাতা নয় যে, কারও খবর কেউ রাখে না। তবু আমি বুকিটা নিই বড় আর এক সনাশ ঠেকাতে।
মা একদিন জিজ্ঞেসই করল, সকালে আজকাল গলা সাধতে বসিস না?
ইচ্ছে করে না।
কত দামি হারমোনিয়ামটা কোলি, কালীবাবু গুচ্ছের টাকা নিচ্ছেন, বলচিকে দিতে হচ্ছে। এ তোর কেমন উড়নচণ্ডী স্বভাব?
ভাল লাগে না, কী করব?
তা হলে রোজ ভোরবেলায় উঠে করিস কী?
মাঝে মাঝে বেড়াতে যাই।
মা মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলে না।
আমি আবার একদিন পাগলা দাশুর জানলায় হানা দিয়ে বলি, আপনি কলকাতার কোথায় থাকেন?
গ্রে স্ট্রিট।
সেটা কোথায়?
উত্তর কলকাতায়। কেন, গ্রে স্ট্রিট চেনেন না? বিখ্যাত জায়গা।
আমি এবার সন্তর্পণে একটা টোপ ফেলি। বলি, আমি কখনও কলকাতায় যাইনি।
যাননি!-বলে খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে লোকটা। বেশ কিছুক্ষণ বাদে বলে, তা হলে আগে আমি আপনাকে কোথায় দেখেছি? কলকাতায় নয়? তবে কোথায়?
আপনি আমাকে আগে কখনও দ্যাখেননি।
পাগলা দাশু মাথা নাড়ে, দেখেছি। ভীষণ চেনা মুখ। ভেবেছিলাম কলকাতায় গেলেই আপনাকে আমার ঠিক মনে পড়ে যাবে। তা নয় তা হলে?