ভদ্রলোক মাথা চুলকোতে চুলকোতে খুব বিনয় ও লজ্জার সঙ্গে হাসছেন। জীবনে অসফল ভদ্রলোকেরা ঠিক এইভাবেই হাসেন এবং নিজেকে নিয়ে অস্বস্তি বোধ করেন। অবিকল আমার সেজোকাকা।
বসুন। আমি বললাম।
মাদুরে আর জায়গা ছিল না। উনি অবশ্য মাদুর-টাদুরের তোয়াক্কা করেন বলে মনে হল না। খুব অভ্যস্ত ভঙ্গিতে মেঝেয় বাবু হয়ে বসে পড়লেন।
এই সময়ে পশুপতি খুব আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে আমাকে ঠেলা দিয়ে বলে, কাজের কথাটা তুলুন না।
কনে কই? আমার মন তার দাবি আবার পেশ করল। আমি বললাম, মেয়েদেরও ডাকুন।
পরদার ফাঁক দিয়ে একটা কচিমুখ উঁকি দিয়েই ছিল, সে-ই জবাব দিল, দিদি সুধাদির বাড়িতে আছে। ডেকে আনব?
ভদ্রমহিলার রক্তাল্পতা কেটে গিয়ে রক্তাধিক্যই দেখা যাচ্ছে এখন। কিন্তু তুখোড় চালাক বলে পলকে হেসে ফেলে বললেন, ওমা। তাই বুঝি! আমাকে তো বলে গেল গানের ক্লাসে যাচ্ছে। তা আন না ডেকে।
মেয়েটা ঘরের ভিতর দিয়েই এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল! পশুপতি ঘাম মুছছে। ভদ্রমহিলা করুণ চোখে চেয়ে বললেন, দেরি হয়ে গেছে বলে বোধ হয় আজ আর গানের ক্লাসে যায়নি।
পশুপতি ঘামভেজা রুমালটা শুকোনোর জন্য মাদুরের ওপর পেতে দিয়ে বলল, এবার কাজের কথাটা হয়ে যাক।
আপনারাই বলুন। ভদ্রমহিলা বললেন, জিনিসটা ঘরের বার করার ইচ্ছে কারও নেই। মেয়েরা তো সারাক্ষণ কিটমিট করছে। কিন্তু আমি বলি, স্কেল চেঞ্জার যখন কেনা হচ্ছেই তখন আর একটা হারমোনিয়াম ঘরে রেখে জঞ্জাল বাড়ানো কেন।
এ সবই দরের ইংগিত। কিন্তু পুরনো বা নতুন কোনও হারমোনিয়ামের দর সম্পর্কেই আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তবে পশুপতি বলেছিল, প্রথমে পঞ্চাশ বলবেন। ধীরে ধীরে পঁচাত্তর অবধি উঠে একদম থেমে যানে।
কিন্তু হারমোনিয়ামটার দিকে না তাকিয়ে কেবল ঘরদোর এবং লোকজনের দিকে চেয়েই পঞ্চাশ টাকা বলতে আমার কেমন বাধোবাধো ঠেকছে।
এ সময়ে ভদ্রমহিলা ডুবন্ত মানুষের দিকে একটা লাঠি এগিয়ে দিয়ে বললেন, পাঁচশো টাকায় কেনা জিনিস।
দরাদরিতে দালালের কথা বলার নিয়ম নেই। তা হলে তার পক্ষপাত প্রকাশ পাবে। পশুপতি শুধু শ্বাস নেওয়া আর ছাড়াটা বন্ধ করে ছিল। ফলে ঘরে একটা গর্ভিনী নিস্তব্ধতার সৃষ্টি হল। প্রচণ্ড টেনশন। দামের কথাটা এখন কে তুলবে?
নিস্তব্ধতা ভেঙে আমি হঠাৎ বললাম, আমি গান জানি না।
ভদ্রমহিলা শুনে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। কথাটার অর্থ বুঝলেন না বোধ হয়।
আমি তাই মৃদু হেসে বললাম, গান না জানলেও হারমোনিয়াম ঘরে রাখার নিশ্চয়ই কিছু-কিছু উপকারিতা আছে।
ভদ্রমহিলা তুখোড় হলেও এ ধরনের কথাবার্তা শুনতে অভ্যস্ত নন। কনে দেখতে এসে কেউ যদি বলে, আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই, তবে যেমনটা হয় আর কি!
উনি তাই বললেন, গান না জানলে হারমোনিয়াম দিয়ে কী করবেন? কিন্তু তা হলে কিনছেনই, বা কেন?
যদি শিখি?
ভদ্রমহিলা একটু নড়ে চড়ে বসে বললেন, সে তো খুব ভাল কথা। শিখতে গেলে হারমোনিয়াম ছাড়া কিছুতেই হবে না।
কিন্তু কে শেখাবে সেইটেই সমস্যা। আমি মুখ চুন করে বলি, একদম বিগিনারকে শেখানোর তো অনেক ঝামেলা। তা ছাড়া আমার কোনও সুরজ্ঞান নেই।
ভদ্রমহিলা ডগমগ হয়ে বলেন, ও নিয়ে আপনাকে মোটেই ভাবতে হবে না। আমিই শেখাব।
আপনি? আপনার তো সংসার করে বাড়তি সময়ই নেই।
সপ্তাহে এক দিন বা দু’ দিন শেখালেই যথেষ্ট। বাদ বাকি দিনগুলোয় আপনি বাসায় বসে প্র্যাকটিস করবেন!
বাইরের দরজার পরদা সরিয়ে এ সময়ে স্নানমুখী একটি মেয়ে ঢুকল। আর সে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরটার যা কিছু খাকতি ছিল, তার পূরণ হয়ে গেল। কনে-দেখা আলো, পুষ্পগন্ধ, রঙ্গমঞ্চের সব সাজ এবং একা ও দুঃখী হারমোনিয়াম সবই সজীব ও অর্থবহ হয়ে উঠল। মন বলল, এইজন্যই তো এতক্ষণ বসে থাকা। অবশেষে কনে এল।
০২. কাটুসোনা
কাল রাতে আমাদের বাড়িতে চোর এসেছিল। মাগো! ভাবতেই ভয় করে। গায়ে কাঁটা দেয়। সবচেয়ে বেশি ভয় ভূতকে আর চোরকে।
আমাদের একটা লোমওয়ালা সুন্দর ভুটিয়া কুকুর ছিল। তার নাম পপি। ছোটখাটো, ভুসকো রঙের, ভারী মিষ্টি দেখতে। ভুক ভুক করে যখন ডাকত তখন ডাকটাও মিষ্টি শোনাত। সেই ছোট্ট একটু কুকুরছানা অবস্থায় আমাদের বাড়িতে আনা হয়েছিল তাকে। আমিও তখন ছোট্ট একটুখানি। টানা বারো বছর আমাদের সঙ্গেই সে বড় হল, বুড়ো হল। তারপর এই তো গেলবার শীতের শেষ টানে মরে গেল একদিন। পপির জন্য আজও বুকের কান্না সব শেষ হয়নি। ভাবলেই কান্না পায়। কেন যে কুকুরের পরমায়ু এত কম! আমি তো এখনও ভাল করে যুবতীও হয়ে উঠিনি, এর মধ্যেই পপি বুড়ো হয়ে মরে গেল!
তা যাই হোক, পপির মতো এত নিরীহ কুকুর হয় না। কোনও দিন কাউকে কামড়ায়নি, রাস্তার কুকুরদের সঙ্গে মারপিট করেনি। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই থাকতে ভালবাসত। তবে ভুক ভুক করে ডাক ছাড়ত ঠিকই। আর তার ভয়েই গত বারো বছরে কোনও দিন আমাদের বাড়িতে চোর আসেনি। পপি মরবার পর এ পর্যন্ত কম করেও দশ-বারো বার চোর হানা দিয়েছে।
কাল রাতের চোরটাকে বাঁটুল দেখেছে। ঠাকুমার কাছে বাঁটুল আর চিনি শোয়। বাঁটুলের ভয়ংকর কৃমির উৎপাত। সারা রাত দাঁত কড়মড় করে। গতবারেও তার গলা দিয়ে এত বড় কেঁচো বেরিয়েছিল। মাঝে-মাঝে সে বিছানায় ছোট-বাইরে করে ফেলে। সেও নাকি কৃমির জন্যই। কাল মাঝরাতে ছোট-বাইরে পাওয়ায় কোন ভাগ্যিতে তার ঘুম ভেঙেছিল। সলতে কমানো হ্যারিকেনের অল্প আলোয় সে দেখতে পায় একটা লম্বা বাঁখারি জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে আলনা থেকে ঠাকুমার থানধুতিটা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বাঁটুল ভয়ে আধমরা অবস্থায় চোখ মিটমিটিয়ে জানালার দিকে চেয়ে দ্যাখে, একটা লোক। কেমন লোক, রোগা না মোটা, কালো না ফরসা, লম্বা না বেঁটে তার কিছুই বলতে পারেনি। শুধু একটা লোককে সে দেখেছে। ওই অবস্থায় আমি হলে ভয়ে জানালার দিকে চাইতামই না। কড়াক্কর করে চোখ বন্ধ করে রাখতাম। বাঁটুল লোকটাকে দেখে ঠাকুমাকে চিমটি দিয়ে জাগিয়ে দেয়।