বলুন।
আপনি কেমন আছেন?
ভাল।
আপনাকে দেখতে এলাম।
আপনি কি ভোরের পাখি? ভোর ছাড়া আসেন না তো।
আমি ফুলচোর। আমার এইটেই সময়।
আমি জানি আপনি আজকাল ফুল চুরি করতে আসেন না।
আপনার বাগানে যে ফুলই নেই। শুধু কাদা আর জল।
ফুল যখন নেই তখন কেন এলেন?
বললাম যে! আপনাকে দেখতে।
আমার কি কোনও অসুখ করেছে?
সে তো আপনারই ভাল জানার কথা। লোকে বলছে আপনি বন্যার সময় খুব খেটেছেন।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার দিকে চেয়ে থাকি। জানালার বাইরে কাকভোরের আবছা অন্ধকারে ফুলচোর দাঁড়িয়ে। আজ গলায় কোনও ইয়ার্কির ভাব নেই।
আমি বিছানায় উঠে বসি। বলি, সেটা কোনও ব্যাপার নয়। আমার অসুখ অন্য।
সেটা কী?
যে শহরে আমি জন্মেছি, বড় হয়েছি, কিছুতেই তার কথা মনে পড়ছে না। কী যে যন্ত্রণা।
জানি। লিচুও আমাকে এরকম একটা কথা বলছিল। আপনার নাকি সায়ন্তনীর কথাও মনে পড়ছে না।
না। কী করি বলুন তো!
ফুলচোর এবার একটু ফাজিল স্বরে বলল, সিনেমায় এরকম ঘটনা কত ঘটে! অ্যাকসিডেন্টে স্মৃতি নষ্ট হয়ে যায়। ফের আর একটা অ্যাকসিডেন্টে স্মৃতি ফিরে আসে। ব্যাপারটা খুবই রোমান্টিক। ভয় পাচ্ছেন কেন?
আমি মাথা নেড়ে বলি, এটা স্মৃতিভ্রংশ নয়।
তবে কী?
মানুষ কিছু জিনিস ভুলতে চায় বলেই ভুলে যায়। কিন্তু আমি কেন কলকাতার কথা ভুলতে চাইছি?
ভুললেন আর কোথায়?- ফুলচোর অন্ধকারেই একটু শব্দ করে হাসে, সেদিন তো নিজের ভালবাসার মহিলাটির কথা অনেক বললেন।
আমি অন্ধকারেই বসে বসে আপনমনে মাথা নাড়ি। বলি, কবে যেন, আজ না কাল, স্বপ্ন দেখছিলাম, আমি একটা লুপ্ত শহর আর একটা লাশ খুঁজতে বেরিয়েছি। দেখি, যেখানে কলকাতা ছিল, সেখানে মস্ত নিলা মাঠ। একটা টিনের পাতে আলকাতরা দিয়ে কে লিখে রেখেছে, হিয়ার লাইজ ক্যালকাটা।
লাশটা কার?
বোধ হয় সায়ন্তনীর।
যাঃ।
আমি বললাম, সেই জন্যই আমি কিছুদিন কলকাতা থেকে ঘুরে আসতে চাই।
ফুলচোর চুপ করে রইল। বহুক্ষণ বাদে বলল, যাবেন কী করে? এখনও ট্রেন চলছে না যে।
প্লেন চলছে। আমাকে যেতেই হবে।
আপনার শরীর তো এখনও দুর্বল।
আপনি আমাকে নিয়ে খুব ভানে তো।
কোনও জবাব এল না।
আধো ঘুমে, আধো জাগরণে আমি টের পাই, ফুলচোর এসেছিল। চলে গেছে।
১০. কাটুসোনা
আমার সর্বনাশ চৌকাঠের ওপাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে। যে কোনও মুহূর্তে ঘরে ঢুকবে। বুকের মধ্যে অলক্ষনে টিকটিকি ডাকছে সব সময় টিক টিক টিক টিক।
আমার জন্ম এই শহরে। আমি এখানে রাজহাঁসের মতো অহংকারে মাথা উঁচু করে হাঁটি। রাজ্যের মেয়ে আমাকে হিংসে করে। আমার বড় সুখের বাঁধানো জীবন ছিল। সেই সব কিছু লন্ডভন্ড করতে কেন এল পাগলা দাশু?
শঙ্কুদার রেস্টুরেন্টের বন্ধুদের কারও মুখই আমি ভাল করে দেখিনি। এতদিনে কারও মুখই মনে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু আশ্চর্য, এই একটা মুখ কী করে যেন খুব অস্পষ্ট জলছাপের মতো থেকে গিয়েছিল মনের মধ্যে। লিচুদের বাড়িতে সেদিন পাগলা দাশু গেরুয়া পাঞ্জাবি পরে না গেলে হয়তোবা কোনওদিনই মনে পড়ত না।
অমিতের সঙ্গে বিয়ে না হলেও আমার তেমন কিছু যাবে আসবে না, ওর সঙ্গে তো আমার ভাব ভালবাসা ছিল না। শুধু জানি লোকটার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। মনটাকে সেইভাবে তৈরি রেখেছি। কিন্তু সেই মন ভেঙে আবার গড়ে নিতে কষ্ট হবে না তেমন, যেটা সবচেয়ে ভয়ের কথা তা হল শঙ্কুদার সঙ্গে আমার সেই ঘনিষ্ঠতা যা আজ পর্যন্ত খুব কম লোক জানে। বলতে গেলে দু’জন, মা আর বড়মামা।
বহুদিন বাদে শঙ্কুদার সুঙ্গে সেই ঘটনাটার গা ঘিনঘিনে স্মৃতি, তার লজ্জা তার ভয় নিয়ে ফিরে এল পরিষ্কার মনে পড়ছে টেবিলের বাঁ ধারে মুখোমুখি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে ছিল পাগলা দাশু। কথা বলছিল খুব কম। তবে মাঝে-মাঝে খুব বড় বড় চোখে চেয়ে দেখছিল আমাকে। যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না ব্যাপারটা।
আর কিছু মনে নেই। শুধু ওইটুকু। পাগলা দাশুরও তেমন করে মনে রাখার কথা নয় আমাকে, কিন্তু তবু কী করে যেন মনে রেখেছে ও। একটু আলোছায়া রয়েছে এখনও, কিন্তু একদিন হঠাৎ মনে পড়বে হয়তো, তক্ষুনি লাফিয়ে উঠবে। বলবে, আরে! সেই মেয়েটা না?
কী লজ্জা!
বড় বেশি পাগল হয়েছিল শঙ্কুদা। রাত্রে হোটেলের ঘরে যখন আমাদের মরণপণ লড়াই চলছে। তখন একবার পাগলের মতো হেসে উঠেছিল, আমার বরা জানে যে তুমি আজ আমার সঙ্গে হোটলে রাত কাটাবে। এই হোটেলের মালিকও ওদেরই একজন। সব জানাজানি হয়ে গেছে কাটু। এখন পিছিয়ে গিয়ে লাভ নেই।
সেই কথাটা এত দিন গুরুতর হয়ে দেখা দেয়নি, আজ বিষ বিছের হল হয়ে ফিরে এল। তার মানে পাগলা দাশুও সব জানে। জানে, কিন্তু মনে পড়ছে। যতক্ষণ মনে পড়ে ততক্ষণসাশ চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে।
ইদানীং আমাদের সম্পর্কটা দাঁড়িয়েছে রক্তকরবীর নন্দিনী আর রাজার মতো। আমি খুব ভোরে উঠে পড়ি। রাতে ঘুমই হয় না। সারা রাত বুকে টিকটিকির ডাক! ঘুমাই কী করে?
প্রায়ই সন্তর্পণে গিয়ে মল্লিকবাড়ির জানলার ধারে দাঁড়াই।
শুনছেন?
পাগলা দাশুও জেগে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে জানলার ধারে, মুখে বিষ হাসি, বলে, ফুলচোর!
ও হয়তো ভাবে, আমি ওর প্রেমে পড়ে গেছি। ভাবুক, যা খুশি ভাবুক, শুধু যেন মনে না পড়ে আমাকে। আমি ওর মাথা আরও গুলিয়ে দেব। মেয়েরা তো পারে ওই সব। আমি কিছু বেশিই পারি।