প্রথম বর্ষায় কিছু জায়গা ডুবেছিল। এই দ্বিতীয় বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নেমে ভেসে যেতে লাগল গাঁ গঞ্জ। শহরের আশেপাশে নিচু জায়গায় জল ঢুকছে। ট্রেন বন্ধ, সড়ক বন্ধ, এরোপ্লেন উড়ছে না।
কখনও আমি লঙ্গরখানায় ধুন্ধুমার জ্বলন্ত উনুনে জাহাজের মতো বিশাল কড়াইয়ে খিচুড়িতে হান্ডা মারছি। ঘামে চুকচুবে শরীর। কখনও দলবল নিয়ে বাজার ঢুড়ে ব্যাবসাদারদের গদি থেকে চাল ডাল তুলে আনছি। কখনও পার্কে ময়দানে বাঁশ পুঁতে খাড়া করছি ক্রিপলের আশ্রয় শিবির। প্রতিদিন শহরের বাইরে ভেসে-যাওয়া গাঁ গঞ্জ থেকে যে হাজার হাজার লোক আসছে তাদের মাথা গুনতি করে বেড়াচ্ছি। মিলিটারির এক বাঙালি ক্যাপটেনের সঙ্গে ভাব করে ডিফেন্সের নৌকোয় চলে যাচ্ছি তোক উদ্ধার করতে। আমি কোথায় তা কাকা কাকিমা টের পায় না, এমনকী অফিস টের পায় না, আমি নিজে পর্যন্ত টের পাইনা। কখন খাচ্ছি, কখন ঘুমোচ্ছি তার কোনও ঠিক ঠিকানা জানি না। মাঝে মাঝে টের পাচ্ছি গায়ের ভেজা জামাকাপড় গায়েই শুকিয়ে যাচ্ছে। চিমসে গন্ধ বেরোচ্ছে শরীর থেকে। দাড়ি যৌবনের রবি ঠাকুরকে ধরে ফেলেছে প্রায়। চুলে জট। গায়ে আঙুল দিয়ে একটু ঘষলেই পুরু মাটির স্তর উঠে আসে। গায়ে গায়ে অনেক ক্ষত ওষুধের অভাবে, এমনিই শুকিয়ে আসছে। আমবাড়িতে একবার জলের তোড়ে নৌকো উল্টে ভেসে গেলাম। ফাঁসিদেওয়ায় অল্পের জন্য সাপের ছোবল থেকে বেঁচে যাই। ডামাডোলে আমার ঘড়িটা হারিয়ে গেছে, জুতোজোড়া ব্যবহারের অযোগ্য হওয়ায় ফেলে দিয়েছি, শার্টটা বদান্যতাবশে এক রিফিউজিকে দিয়ে দিলাম। এখন আছে শুধু গেঞ্জি ছেঁড়া প্যান্ট, আর আছি আমি। গুরুং বস্তির অন্তত শ দুয়েক লোক নিখোঁজ। মাইল পাঁচেক দূরে খরস্রোতা নদী বেয়ে গিয়ে গাছ থেকে আমরা জনা দশেক আধমরা মানুষকে উদ্ধার করলাম। তিস্তার জলের তোড়ে সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়া এক দুর্গম শহরে ঢুকে লাশ আর জিয়ন্ত মানুষ বাছতে হিমশিম খেতে হল। আমি কী করে এখনও বেঁচে আছি, তাই আশ্চর্য লাগে খুব।
কলকাতাতেও বৃষ্টি পড়ছে কি? কীরকম হয়েছে এখন কলকাতার অবস্থা? চোখ বুজে ভাবতে গিয়ে দেখি, গোটা কলকাতাকেই উপড়ে নিয়ে কে যেন একটা উঁচু পাহাড়ের ঢালে যত্ন করে সাজিয়েছে। ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে।
বাচ্চাদের জন্য মন্ত লোহার ড্রামে খাবলে খাবলে গরম জলে গুঁড়ো দুধ গুলতে গুলতে আমি একটা মস্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কলকাতাকে নিয়ে ভাবার এর পর কোনও মানেই হয় না। সময়ও নেই। রিলিফের কাজ করতে করতে কখন যে সবাই আমার ঘাড়ে সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে কে জানে। চেনা অচেনা, ছেলে বুড়ো অফিসার পাবলিক হাজারটা লোক মুহুর্মুহু এসে এ কাজে সে কাজে পরামর্শ চাইছে। কর্ণদা, কর্ণবাবু, কর্ণ ভায়া, মল্লিক মশাই, মিস্টার মল্লিক, মল্লিক শুনতে শুনতে কান ঝালপালা। সব কাজই আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। তবু একটা আমি যেন দশটা হয়ে উঠি। এবং দশ থেকে ক্রমে এগারোটা, বারোটা ছাড়িয়ে একশোর দিকে এগোই।
কে যেন এসে খবর দিল, কর্ণদা, আপনার অফিসের পিয়োন আপনাকে খুঁজতে এসেছে।
অফিস! আমি লজ্জায় জিব কাটি। এতদিনে অফিসের কথা একদম খেয়াল ছিল না। পিয়োন আমাকে দেখে চোখ কপালে তোলে, আপনিই কি আমাদের জুনিয়ার অফিসার কর্ণ মল্লিক? একদম পাল্টে গেছেন স্যার!
আমি একটু হাসবার চেষ্টা করলাম মাত্র। পিয়োন আমাকে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে গেল। আজ ফ্লাড সিচুয়েশন নিয়ে অফিসারদের জরুরি মিটিং। বেলা বারোটায়।
আজকাল কোথাও বসে একটু বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করলেই আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই, সেই ভয়ে এক মুহূর্তও আমি বসি না। কিন্তু জেলা অফিসারের ঘরের মিটিং-এ গদি আঁটা চেয়ারে বসে ফ্লাড সিচুয়েশন সম্পর্কের কথা শুনতে শুনতে বার বার আমার চোখ চুম্বকের মতো সেঁটে যাচ্ছিল. জেলা অফিসারপ্রথমেআমাকে চিনতে পারেননি। তারপর বলেছেন, ইউ লুক ভেরি সিক। তারপর নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বলেছেন, ইউ স্টিক।
সবই সত্য। তবে আমার কীইবা করার আছে?
মিটিংএর শুরুতেই জেলা অফিসার বললেন, ফ্লাডের যা অবস্থা তাতে আমাদের ইমিডিয়েটলি রিলিফ ওয়ার্ক করতে হবে। আপনারা এক একজন এক একটা রিলিফ ওয়ার্কের চার্জ নেবেন। সরকারি অর্ডার, অফিসারকেই রিলিফ ওয়ার্কে নামতে হবে।
আমি হাই তোলায় জেলা অফিসার আমার দিকে কঠিন চোখে একবার তাকালেন। বললেন, ডোন্ট ইউ অ্যাগ্রি?
ইয়েস স্যার।
আমি ওপর নীচে মাথা নাড়লাম। বাড়ি যাওয়ার সময় পাইনি। ক্যাম্প থেকে একজন ভলান্টিয়ারের আধময়লা জমা চেয়ে পরে এসেছি। একজোড়া হাওয়াই চটি ধার দিয়েছে আর একজন। আমাকে নিশ্চয়ই বিশ্বস্ত অফিসারের মতো দেখাচ্ছে না!
জেলা অফিসার সবাইকে কাজ ভাগ করে দিচ্ছিলেন। আমি অতি কষ্টে বার বার ঘুমিয়ে পড়তে পড়তেও জেগে থাকার চেষ্টা করছি।
মিস্টার মল্লিক।
ইয়েস স্যার।
আপনি কীসের চার্জ নেবেন?
আমি ঘুমকাতর গলায় বলি, আমি জীবনে কখনও রিলিফ ওয়ার্ক করিনি। আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই।
হিমশীতল গলায় জেলা অফিসার বললেন, কথাটা সত্যি নয় মল্লিক। আপনি গত কয়েকদিন অফিসের কাজ ফেলে রেখে বিস্তর রিলিফের কাজ করছেন। কিন্তু তার একটাও সরকারি নীতিবিধি মেনে করেননি। একজন সরকারি অফিসারের দায়িত্ব যা হতে পারে তার একটাও পালন করেননি।