আমার গা জ্বলে যায়। বলি, কী বলতে এসেছেন বলুন তো!
রাগ করলেন?
না, সাবধান হচ্ছি। আমার কাকা কাকিমাও আরলি রাইজার। যে কোনও সময়ে এদিকে এসে পড়তে পারেন।
ও বাবা!
বলে ফুলচোর চকিতে একবার চারদিক দেখে নেয়। এখনও যথেষ্ট আলো ফোটেনি। আবছা আলোর মধ্যে এখনও ভুতুড়ে দেখাচ্ছে গাছপালা, ঘরবাড়ি। ফুলচোর আমার দিকে আবার মুখ ফিরিয়ে বলে, লিচুর সঙ্গে কি আপনার ঝগড়া হয়েছে?
তা দিয়ে আপনার কী দরকার?
লিচু ভীষণ কাঁদছে যে।
কাঁদছে! কেন কাঁদছে?
তার আমি কী জানি? পাড়ার লোকে বলছে, আপনার সঙ্গে নাকি ওর ভাব ছিল।
মোটেই নয়।
ফুলচোর আচমকা জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা ন্যাপথালিন খেলে কি লোকে মরে?
আমি জানি না। কেন?
লিচু ন্যাপথালিন খেয়ে মরার চেষ্টা করেছিল। হাসপাতালে পর্যন্ত নিতে হয়।
উদ্বেগের সঙ্গে আমি জিজ্ঞেস করি, বেঁচে আছে তো!
আছে। কিছু হয়নি। বেশি খায়ওনি। হাসপাতালে পেটে নল ঢুকিয়ে সব বের করে দিয়েছে।
মরতে চেয়েছিল কেন?
বোধহয় আপনার জন্য। অবশ্য ভেঙে কিছু বলছে না।
আমি একটু রেগে গিয়ে বলি, এতক্ষণ ইয়ার্কি না করে এই সিরিয়াস খবরটা অনেক আগেই আপনার দেওয়া উচিত ছিল।
আপনার সঙ্গে যে আমার ইয়ার্কিরও একটা সম্পর্ক আছে।
তার মানে?
পালাই, আপনার অত ভয়ের কিছু নেই। লিচু ভাল আছে।
কিন্তু ইয়ার্কির সম্পর্ক না কী যেন বলছিলেন।
না, বলছিলাম যে, আমি ভীষণ ইয়ার্কি করি। বাড়িতে তার জন্য অনেক বকুনিও খাই। বলে ফুলচোর আবার হি হি করে হাসে। তারপর বলে, লিচু কিন্তু খুব কাঁদছে।
তার আমি কী করতে পারি?
আপনি কি ওকে রিফিউজ করেছেন?
রিফিউজের প্রশ্ন ওঠে না। ফর ইয়োর ইনফর্মেশন, আমি একজনকে অলরেডি ভালবাসি!
তাই বলুন। বাব্বা! ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
কেন?
আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম, আপনি লিচুকেই বুঝি বিয়ে করবেন।
বিয়ে অত সস্তা নয়।
আপনার লাভার কি কলকাতার মেয়ে?
হ্যাঁ।
খুব স্মার্ট?
তা জেনে কী হবে?
বলুন না। আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে।
স্মার্ট বটে, তবে আপনার মতো নয়।
দেখতে?
তাও আপনার মতো নয়। রূপটাই কি সব?
সে অবশ্য ঠিক। গায়ের রং কেমন? খুব ফরসা?
না। শ্যামলা। আপনার পাশে দাঁড়ালে কালোই বলবে লোকে।
লম্বা?
লম্বা আপনার মতো নয়। অ্যাভারেজ।
রোগা?
হ্যাঁ, বেশ রোগা।
বোধ হয় পড়াশুনোয় ব্রিলিয়ান্ট?
একদম নয়। তবে গ্র্যাজুয়েট।
বয়স?
আমার প্রায় সমান। আপনার তুলনায় বুড়ি।
বারবার আমার সঙ্গে তুলনা দিচ্ছেন কেন?
খুশি করার জন্য! মেয়েরা অন্য মেয়েদের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দেখতে ভালবাসে।
আচ্ছা, আচ্ছা। এবার বলুন তার নাম কী?
সায়ন্তনী। আপনার নামটা কি তার চেয়ে ভাল?
চালাকি করে নাম জেনে নেবেন, আমি তত বোকা নই।
নামটা বলতে দোষ কী?
চোরেরা নাম বলে না।
না কি অন্য কোনও কারণ আছে?
থাকতে পারে। সকাল হয়ে এল, আমি যাই!
আবার কবে আসছেন?
নিচু হয়ে ঝোপ পেরোতে পেরোতে এবার ফিরে তাকায় ফুলচোর। চাপা স্বরে বলে, এলে খুশি হবেন?
বোধ হয় খারাপ লাগবে না। আজ তো বেশ লাগল।
ফুলচোর হি হি করে হাসে, তাহলে আসব।
বলে ঝোপটা জোর পায়ে পেরিয়ে চলে গেল ফুলচোর। ওকে বলা হল না যে, সব কথা আমি সত্যি বলিনি। কী করে বলব? সায়ন্তনীর চেহারাটা আমার মনে পড়ছে না যে।
০৮. কাটুসোনা
আজ দুপুরে হাউহাউ করে হঠাৎ পপির জন্য খানিকটা কাঁদলাম।
দুপুরে এক বারনাচওলাকে ধরে এনেছিল বাঁটুল, দড়ি বাঁধা দুটো বাদর ডুগডুগির তালে নাচল, ডিগবাজি খেল, পরম্পরকে পছন্দ করল, বিয়ে করল। খেলার ফাঁকে ফাঁকে পুটুর পুটুর চেয়ে দেখল ভিড়ের মানুষদের। বসে বসে আমাদের দেওয়া কলা ছাড়িয়ে খেল।
বড় কষ্ট বাঁদরগুলোর। খেলা দেখতে দেখতে অবোলা জীবের কষ্টেযখন বুকে মোচড় দিল একটু তখনই পপির কথাও মনে পড়ে গেল। কাজল-পরানো মায়াবী একজোড়া চোখ ছিল পপির। কী মায়া ছিল ওর দৃষ্টিতে! তাকিয়ে থাকত ঠিক যেন আনজনের মতো। কথাটাই শুধু বলত না, কিন্তু আর সবই বোঝাতে পারত হাবেভাবে। এসব মনে পড়তেই বুকের মোচড় দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। ঘরে গিয়ে কাঁদতে বসলাম।
কাঁদতে যে কী সুখ! কাঁদতে কাঁদতে পপিকে ছেড়ে আরও কত কী ভাবতে ভাবতে আরও কাঁদতে থাকি।
গতবারই কলকাতায় একটা বিশ্রী কাণ্ড হয়ে গেল। ভৈরবকাকার সঙ্গে মা আর আমরা ভাইবোনেরা মামাবাড়ি বেড়াতে গেলাম। মার বাপের বাড়ি যাওয়া আর সেই সঙ্গে কলকাতা থেকে পুজোর বাজার করে আনা, দুই-ই হবে। মামারা কেউ এক জায়গায় থাকে না। তাছাড়া কারওরই বাসা খুব বড় নয়। ফলে আমরা এক এক বাসায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লাম। আমাকে নিয়ে গেল হাতিবাগানের বড়মামা।
বলতে কী মামাবাড়িতে আমাদের বড় একটা যাওয়া হয় না। কলকাতা শহরটা আমাদের কাছে বড় ভয়ের। সে এক সাংঘাতিক ভিড়ে ভরা শহর। মাথা গুলিয়ে দেওয়া ধাঁধার মতো রাস্তাঘাট। তার ওপর আত্মীয়দের কারও বাড়িতেই হাত পা ছড়িয়ে থাকার মতো জায়গা হয় না! আমরা সেখানে গেলে একা বেরোতে পারি না, রাস্তা পেরোতে বুক ঢিপ ঢিপ করে। ফলে আমরা কলকাতায় কালেভদ্রে যাই। হয়তো নিচার বা পাঁচ বছর পর। ততদিনে কলকাতার আত্মীয়দের সঙ্গে আবার একটু অচেনার পর্দা পড়ে যায়।
বড়মামার মেয়ে মঞ্জু আমার বয়সী, ছেলে শঙ্কু তিন-চার বছরের বড়। সেই বাড়িতে পা দিতে না দিতেই আমি টের পেলাম আমার মামাতো দাদা শঙ্কর মাথা আমি ঘুরিয়ে দিয়েছি। বলতে নেই, ব্যাপারটা আমি উপভোগই করেছিলাম। কাছাকাছি একটা কাঁচা বয়সের ছেলে রয়েছে, অথচ আমাকে দেখে সে হাঁ করে চেয়ে থাকছে না, নিজের কেরানি দেখানোর জন্য নানা বোকা-বোকা কাণ্ড করছে না বা নিজের কৃতিত্বের কথা বলতে গিয়ে আগডুম বাগড়ম বকছে না–সেটা আমার অহংকারে লাগে।