কাটু হয়তো ভাবী দেওরের স্বার্থ ভেবেই বলেছে।
মেয়েটাকে চিনিয়ে দিয়ো। বকে দেব।
ও বাবা!– লিচু ভয়-খাওয়া হাসি হেসে বলল, কাটুকে বকার সাহস কারও নেই। যা দেমাক!
খুব দেমাক নাকি?
ভীষণ। অবনী রায়ের মতো পাত্রকেই পাত্তা দেয়নি।
দেমাক তোমারও আছে। আমি মেয়েদের দেমাক পছন্দ করি।
আহা, আমার দেমাক দেখলেন কোথায়?
দেখেছি। যার আছে সে বোঝে না। অবনী রায়টা কে?
শচীবাবুর ছেলে। বিরাট বড়লোক। তার ওপর খুব শিক্ষিতও বটে। কাটু হায়ার সেকেন্ডারিতে ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছিল ওঁর জন্যই তো! সেই কৃতজ্ঞতাবোধটুকু পর্যন্ত কাটুর নেই। বয়সের অবশ্য একটু তফাত ছিল, কিন্তু তাতে কী?
কাটুর জায়গায় তুমি হলে অবনী রায়কে বিয়ে করতে?
লিচু মুখ ফিরিয়ে হঠাৎ আমাকে চোখের ছোবল মারল। বলতে নেই লিচুর চোখদুটি বিশাল। বলল, হঠাৎ আমার কথা কেন?
সব জিনিস নিজের ঘাড়ে নিয়ে ভাবতে হয়, তবে বোঝা যায় অন্যে কেন কোন কাজটা করল বা করল না।
লিচু হেসে বলল, কাটুর মতো কপাল কি আমার! আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ বিয়েই করতে চায়নি। তাহলে কী করে নিজের ঘাড়ে নিয়ে ভাবব বলুন!
আমি বললাম, এ কথাটা সত্যি নয় লিচু।
লিচু মাথা নিচু করল হঠাৎ। তারপর মাথা তুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
আমরা একটা মাঠের ভিতর পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে হাটছিলাম। সকালে বৃষ্টি হয়ে গেছে খুব। মাঠে অল্প-স্বল্প কাদা ছিল। দু’ধারে দুটো সাদা বাঁকাচোরা গোলপোস্ট। জ্যোৎস্নায় ঝিমঝিম করছিল চারিধার।
লিচু ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ, চেয়েছিল। তাতে কী?
তুমি কি তাদের পাত্তা দিয়েছ?
লিচু মাথা নেড়ে হেসে বলে, পাত্তা দেওয়ার মতো নয়।
আমি শ্বাস ফেলে বললাম, দেমাক কারও কম নয় লিচু।
দুই গোলপোস্টের মাঝামাঝি জ্যোৎস্নার কুহকে আমাদের মতিচ্ছন্ন হয়ে থাকবে। লিচু টলটলে জ্যোৎস্নায় বোয়া স্বপ্নাতুর দুই চোখ তুলে তাকাল। জাদুকর পি সি সরকাররাত দিয়ে মেয়ে কাটার আগে যেভাবে তাকে সম্মোহিত করতেন অবিকল সেই সম্মোহন আমার ওপর কাজ করছিল।
লিচু ধরা গলায় বলল, দেমাক। আমাদের আবার দেমক!ী আছে বলুন তো আমার দেমাক করার মতো?
দেমাকের জন্য কিছু থাকার দরকার হয় না। শুধু দেমাক থাকলেই হয়। দেমাক থাকা ভাল লিচু, তাহলে আজেবাজে আমার মতো লোককাহ যেতে পারে না।
ভুল হয়েছিল, বড় ভুল হয়েছিল ওই কথা বলা। জ্যোৎস্না ঢুকে গিয়েছিল মাথার মধ্যে, বুকের মধ্যে। চোখের সম্মোহন ছিল বড়ই গভীর। মাথায় ছিল মি।
লিচু ঠিক সেন্টার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল। মুৰতুলে স্পষ্ট করে চাইল আমার দিকে। বলল, তাই বুঝি?
আমি একটা সাদা গোলপোস্টের দিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলাম। ওই গোলপোস্টে আমার হাত ফসকে কতবার গোলে বল ঢুকে গেছে। ছেলের বলে, পাগলা দাও এত গোল খায় যে বাড়িতে গিয়ে আর ভাত খেতে হয় না।
আমি বললাম, তাই নয় বুঝি?
লিচু মাথা নত করে বলল, আমি বুঝি তোমাকে যেতে দিই না? আর কীভাবে বোঝাব বলো তো? বোকা কোথাকার!
এত সুন্দর গলায় বলল যে, জ্যোৎস্না আর একটু ফরসা হয়ে উঠল। আমি স্পষ্ট দেখলাম, আকাশ থেকে চাঁদটা গড়িয়ে পড়ল মাঠের মধ্যে। পড়ে লাফাল বার কয়েক কে যে চাঁদটাকে ফুটবলের মতো শট করল তা বোঝা গেল না। কিন্তু পশ্চিম ধারের গোলপোস্টে সেটা কোনাকুনি ঢুকে গেল বিনা বাধায়। আমি হাত বাড়িয়েও গোল আটকাতে পারলাম না।
কিন্তু নেপথ্যে একটা গলার স্বর বারবার আমাকে কী যেন প্রম্পট করছিল। ফিসফিস করে খুব জরুরি গলায় বলছিল, বলুন। বলুন। এই বেলা বলে ফেলুন।
লিচু নতমুখ তুলে একটু হাসল।
আমি হাত বাড়িয়ে লিচুর একটা হাত ধরলাম। গলা আমারও ধরে এসেছে। বুকের মধ্যে দ্বন শ্বস। বললাম, লিচু, আমি যে তোমাকে…
ঠিক এই সময়ে আমার মাথার মধ্যে লাউড স্পিকারের ভিতর দিয়ে প্রম্পটার বলে উঠল, না।! মনে নেই কী শিখিয়ে দিয়েছিলাম।
আমি চিনলাম। আমার মাথার মধ্যে প্রম্পট কমছে পশুপতি। পশুপতি তাড়া দিয়ে বলল, আহা! টাকার কথাটা বলুন। বলুন!
আমি লিচুর দিকে চেয়ে যে কথাটা বলতে চেয়েছিলাম সেটা গিলে ফেলে নতুন করে বললাম, লিচু, তোমার বাবার কাছে আমি এখনও একশো পঁচাত্তর টাকা পাই।
লিচুর হাত চমকে উঠে খসে গেল আমার মুঠো থেকে।
আমি ফ্লাস্কের মুখ বন্ধ করি এবং পাথরের চাতাল ছেড়ে আবার পাহাড়ে ওঠা শুরু করি। এর চূড়ায় আমাকে উঠতেই হবে।
রাস্তাটা আর দেখতে পাই না। গাছের গোড়ায়, পাথরে বহুকালের পুরোনো শ্যাওলা। লতাপাতায় জড়ানো ঘন গাছের জল। পথ নেই। ডাইনে বাঁয়ে খুঁজে অবশেষে আমি একটা নোরার সন্ধান পেয়ে যাই। এখনও তেমন বর্ষা শুরু হয়নি বলে জলধারা প্রবল নয়। ঝিরঝির করে কয়েকটা সরু ধারা নেমে যাচ্ছে। খাত বেয়ে আমি উঠতে থাকি। বড্ড খাড়াই। পা রাখার জায়গা। পাই না। ফলে আবার জঙ্গলে ঢুকে যেতে হয়। আদাড় বাদাড়ি ভেঙে প্রাণপণে শুধু উঁচুতে ওঠা বজায় রাখি।
কিন্তু না উঠলেই বা কী?
পায়ের ডিম আর কুচকিতে অসহ্য শিরার টান টের পেয়ে আমি দাঁড়িয়ে কথাটা ভাবি। উপরে উঠে আমি কিছু পাব না। না পাহাড় জয়ের আনন্দ, না ব্যায়ামের সুফল।
উপর থেকে একটা ঘটানাড়া পাখির ডাক আসছিল। তীব্র, উঁচু একটানা, অবিকল পুজোর ঘণ্টার মতে। সেই ধ্বনির মধ্যে বারবার একটা না না না না’ শব্দ বেজে যাচ্ছে। জীবন কিছু না, প্রেম কিছু না, অর্থ কিছু না, মায়া মোহ কিছুই কিছুনা।