সেজোকাকা উঠে পড়েছে, টের পাচ্ছি! ভিতরবাড়িতে তার হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। কাকিমা কাল রাতে বোধ হয় ত্রিফলার জল দিতে ভুলে গেছেন। সেজোকাকা চেঁচিয়ে বলছেন, এখন সকালে কোষ্ঠ পরিষ্কার হবে কী করে? কোষ্ঠ পরিষ্কার না হলে দিনটাই যে মাটি!
সুন্দরীদের এইসব প্রসঙ্গ না শোনাই ভাল। তারা আলো আর বুলবুলির মতো জীবনের গাছে ডালে ডালে খেলা করবে। কোষ্ঠ পরিষ্কারের মতো বস্তুগত বিষয়ে তাদের না থাকাই উচিত।
আমি বললাম, আপনি এবার চলে যান। বেলা হয়েছে। আমার কাকা-কাকিমা উঠে পড়েছে।
ফুলচোর একটু ফিচকে হাসি হেসে কোচড়টা আগলে ফটকের দিকে যেতে যেতে মুখ ফিরিয়ে বলল, আবার দেখা হবে কিন্তু।
হবেই তো। আমি জানি, দেখা হবে! বললাম, নিশ্চয়ই, রোজ আসবেন!
০৬. কাটুসোনা
সকালে কাক ডাকল কা, অমনি ফটকের কাছে ভিখিরিও ডাকল, মা!
বলতে কী সকাল থেকেই আমাদের বাড়িতে ভিখিরির আনাগোনা। প্রথম আসে রামশংকর। আমার জন্মের আগে থেকে আজ পর্যন্ত সে সপ্তাহে ক্যালেন্ডার ধরে তিন দিন আসবেই। সে এলেই বুঝতে পারি, আজ হয় সোম, নয়তো বুধ, না হয়তো শনিবার। রামশংকরকে সবাই চেনে হাঁটুভাঙা রামা বলে। দিব্যি স্বাস্থ্য। দোষের মধ্যে তার হাঁটু সোজা হয় না। বাঁকা হাঁটু নিয়ে খানিক নিলডাউন হয়ে সে হাটে। বেশ জোরেই। রামার আবার তাড়া থাকে। একবার-দুবার ডাকবে, মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে ভিক্ষে না পেলে সে ভারী রাগারাগি শুরু করে দেয়, আরে, এইসন হোলে আমার চলবে? আমারও তো পাঁচঠো বাড়ি যেতে হোবে, তার পোরে তো পেট ভোরবে! এ হো দিদি, ও মাইজি, এ বুডটা মাইজি, আরে ও খোকাবাবু…
ভিক্ষের চাল আলাদা একটা লোহার ড্রামে থাকে। তাতে জারমান সিলভারের একটা কৌটো। ভরভরন্ত এক কৌটো চাল পেয়ে রামশংকর গেল তো এল অন্নদা বুড়ি। তার নাম অবশ্য অন্নদা নয়। ম্যাট্রিকুলেশন বেঙ্গলি সিলেকশনে ভারতচন্দ্রের একটা কবিতা ছিল, অন্নদার জরতী বেশে ব্যাস ছলনা। অন্নদা যে বুড়ির বেশ ধরে ব্যাসদেবকে ছলনা করে নতুন কাশীকে ব্যাসকাশী বানিয়েছিলেন এই বুড়ি হুবহু সেইরকম। ফটকের কাছে বসে মাথার উকুন চুলকোবে, ঘ্যানর ঘ্যানর করে সংসারের দুঃখের কথা বলবে, ভিক্ষেটা বড় কথা নয় তার কাছে, কথা বলতে পারলে বাঁচে। ভৈরবকাকা তার নাম দিয়েছেন অন্নদা বুড়ি।
বোবা মুকুন্দ আসে রোববার আর ছুটির দিনে। লোকে বলে সে ফাঁসিদেওয়ায় এক ইস্কুলে দফতরির কাজ করে। ছুটিতে ভিক্ষে করতে বেরোয়। সেও এক কৌটো চাল নেয়। আর আসে ছেলে কোলে নিয়ে মানময়ী। বলতে কী মানময়ীও তার নাম নয়। বছরের পর বছর সে একটা বছরখানেক বয়সের ছেলে কোলে নিয়ে আসছে দেখে একদিন ঠাকুমার সন্দেহ হয়। ঠাকুমা সেদিন জিজ্ঞেস করেছিল, বলি ও মেয়ে, তোমার কোলের বাচ্চাটি কি সেই আগেরটাই? না কি একে আবার নতুন জোগাড় করেছে? এই শুনে মানময়ী কেঁদে আকুল, আমার পুয়ে পাওয়া বাচ্চাটাকে নিয়ে এত কথা কীসের তোমাদের? না হয় ভিক্ষেই দেবে, তা বলে কি আমাদের মান নেই? সেই থেকে মানময়ী। তবে আমরাও জানি মানময়ীর কোলের বাচ্চার বয়স বাড়ে না। একজন একটু বড় হয় তো ঠিক সেই বয়সী আর একটাকে কোত্থেকে জোগাড় করে আনে। কিন্তু সে কথা বলবে এত বুকের পাটা কার?
বাঁধা ভিখিরি দশ বারোজন। তাছাড়া উটকো ছুটকো আরও জনা বিশেক। কেউ শুধু হাতে ফিরবে না, মায়ের আর ঠাকুমার এই নিয়ম। পপি বেঁচে থাকতে সেও ভিখিরি দেখলে ঘেউ-ঘেউ করত না, বরং দৌড়ে এসে ভিতরবাড়ির খবর দিত।
ভিখিরি নানারকমের আছে। কেউ ফটকের ওপাশ থেকে হাত বাড়ায়, কেউ বা ভিতরবাড়িতেও আসে ভিখিরিপানা করতে। আমি বয়সে পা দিতে না দিতেই এরকম কয়েকজন ভিখিরির আনাগোনা শুরু হয়ে গেল।
একবার আমাদের পুরনো রেডিয়োটা খারাপ হওয়াতে হিলকার্ট রোড থেকে দাদা পন্টুদাকে নিয়ে এল।
পদা রেডিয়ো দেখবে কী, আমাকে দেখে আর চোখই সরাতে চায় না। সেদিনই মা’র সঙ্গে মাসিমা পাতিয়ে বাবাকে মেশো ডেকে ভিত তৈরি করে রেখে গেল। তারপর প্রায়ই সাইকেলে চলে আসে। পন্টুদার রেডিয়ো সারাই ছাড়া আর তেমন কোনও গুণ আছে বলে কেউ জানে না। বেশ মোটা থলথলে চেহারা। কথা বলার সময় শ্বসের জোরালো শব্দ হয়। হাসিয়ে দিলে হেসে বেদম হয়ে পড়ে।
আমার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পন্টুদা বিস্তর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বেচারা! কী দিয়ে চোখ টানবে তা বুঝতে না পেরে তার যে আর একটা মাত্র বাহাদুরি ছিল সেইটেই আমাকে দেখাতে চাইত। সেই বাহাদুরিটা হল খাওয়া। বকরাক্ষসের মতো এমন খেতে আমি আর কাউকে দেখিনি। মা আর ঠাকুমা লোককে খাওয়াতে ভালবাসে। পন্টুদা রোজ খাওয়ার গল্প ফাঁদে দেখে একদিন তাকে নেমন্তন্ন করা হল। দেড় সের মাংস আর সেরটাক চালের ভাত ঘপাৎ ঘপাৎ করে খেল পন্টুদা, আগাগোড়া আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে আর মৃদু মৃদু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে। খাওয়ার শেষে আমাকেই বলল, দেখলে তো কাটু, পারবে আজকালকার ছেলেরা এরকম? পঁচিশ খানা রুটি আর দুটো মুরগি আমি রোজ রাতে খাই।
মেয়েরা যে খাওয়ার ব্যাপারটা পছন্দ করে না এটা পন্টুদাকে কেউ বুঝিয়ে দেয়নি। তাই এর পর থেকে পন্টুদা প্রায়ই বাইরে থেকে পাঁচ দশ টাকার তেলেভাজা কি পঞ্চাশটা চপ কিংবা পাঁচ সের রসগোল্লা নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসত। এ বাড়ির কেউ তেমন খাউন্তি নয়। দু’চারখানা সবাই মিলে হয়তো খেল, বাকিটা পন্টুদা। খেয়ে উদগার তুলে বলত, এখনও যতটা খেয়েছি ততটা আরও পারি। বুঝলে কাটু! খাওয়াটা একটা আর্ট!