আমি মাথা নেড়ে বলি, সে আমি পারব না।
পশুপতি খুব আন্তরিকভাবে বলে, কথাটা অন্যদিক দিয়ে ভেবে দেখুন। যদি আপনার টাকাটা ওরা মেরেই দেয় তবে সেটা তো ওদের পাপই হল? জেনেশুনে একটা লোককে পাপের ভাগী হতে দেওয়াটা কি ভাল? শক্ত কাজ কিছু তো নয়!
অগাদা দিতে আমার লজ্জা করবে। থাকগে টাকা।
পশুপতি স্নেহের সঙ্গে বলে, আপনি ভীষণ ছেলেমানুষ। একটু শক্ত-পোক্ত না হলে, চক্ষুলজ্জা-টজ্জা বাদ না দিলে এই মতলববাজদের দুনিয়ার টিকে থাকবেন কী করে? কী করতে হবে তা শিখিয়ে দিচ্ছি। বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে হিলকার্ট রোডে লিচুর বাবার সাইকেলের দোকানে বেড়াতে বেড়াতে গিয়ে হাজির হবেন। বৃষ্টি বাদলার কথা বলবেন, বাজার দরের কথা বলবেন, চলে আসবার সময় খুব আলতো করে বলে আসবেন, সেই হারমোনিয়ামের টাকাটার কথা মনে আছে তো? ব্যস, ওতেই হবে। শুধু মনে করিয়ে দেবেন মাঝে মাঝে।
আমি চুপ করে আছি দেখে পশুপতি মিটিমিটি হেসে বলল, দাসীর কথা বাসি হলে কাজে লাগে। একটা পরামর্শ দিয়ে রাখি। লিচু যদি বেশি মাখামাখি করতে আসে, আর আপনিও যদি ভজে যান, আর তারপর যদি কখনও ওর হাত থেকে বাঁচবার জন্য আঁকুপাঁকু করেন তাহলে মাঝে মাঝে লিচুকেও টাকার কথাটা বলবেন। প্রেম কাটানোর এমন ওষুধ আর নেই। টাকার তাগাদা হল হাতুড়ির ঘা, আর প্রেম হল ঠনঠুন পেয়ালা।
ব্যাপারটা এই পর্যন্ত হয়ে থেমে আছে। পশুপতির কথায় আমি গুরুত্ব দিইনি বটে কিন্তু ভারী একটা অস্বস্তি হচ্ছে সেই থেকে। গতকাল সকালেই লিচুর বাবা এসে ওঁদের বাড়িতে সত্যনারায়ণ পূজোর নেমন্তন্ন করে গিয়েছিল। আমি যাইনি অস্বস্তিতে। নিজের ওপর আমার কোনও বিশ্বাস নেই। এই সেদিনও হারমোনিয়ামটা কিনতে গিয়ে আমার মন কনে কই, কনে কই’ বলে নাচানাচি জুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে আমার কমে তো ঠিক হয়েই আছে, কতকাল ধরে। কলকাতার হিদারাম বাঁড়ুজ্জে লেনের সায়ন্তনীই আমার সেই ভাবী কনে। তবু যে আমার মন মাঝে মাঝে দুর্বল হয় তার কারণ বোধ হয়, সায়ন্তনী আর আমার মাঝখানে কয়েকশো মাইলের মাঠ-ঘাট, জল-জঙ্গল, নদী-নালার দূরত্ব। তারপর উত্তরের এই হিমালয়-ঘেঁষা জায়গাটার দোষ আছে। প্রথম প্রথম এখানে এসে আমার কলকাতার জন্য মন কেমন করলেও ধীরে ধীরে এ জায়গার বাতাসে একটা গভীর বনজঙ্গলের মাতলা গন্ধ, উত্তরে ভোরের ব্রোঞ্জ রঙা পাহাড়ের ধীরে ধীরে রং পালটানো, উদাস আকাশ আমাকে নানা ব্যঞ্জন দিয়ে ধীরে ধীরে মেখে ফেলেছে। ছুটির দিনে নতুন নতুন পাহাড় আর জঙ্গল খুঁজতে গিয়ে এমন গভীর নির্জনতার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় যে আর ফিরতে ইচ্ছে করে না। তাই ধীরে ধীরে কলকাতার কথা ভুলে যাচ্ছি। কলকাতার কথা মনে না পড়লে কিছুতেই সায়ন্তনীর কথাও মনে পড়ে না। আর যত সায়ন্তনীর কথা মনে না পড়ে তত আমি নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি।
আজকাল আমি নিয়ম করে রোজ সকাল বিকেল দু’ঘণ্টা করে কলকাতা আর সায়ন্তনীর কথা ভাবতে চেষ্টা করি। ঠিক পরীক্ষার পড়ার মতো করে। কিন্তু খারাপ পড়ুয়া যেমন বারবার ঘ্যান ঘ্যান করে মুখস্থ করেও পড়া ভুলে যায়, আমারও অবিকল সেই অবস্থা।
আজও ভোরবেলা উঠে আমি জানালা দিয়ে ব্রোঞ্জ রঙের পাহাড়ের দিকে চেয়েই বুঝলাম, ওই চুম্বক পাহাড় রোজই একটু একটু করে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার মগজ ধোলাই করছে। কলকাতাকে মনে হয় পিকিং বা আডেলেডের মতো দূরের শহর।
ফলে আজ সকালে আমি উঠে প্রথমে কিছুক্ষণ কলকাতার অলিগলি, আবর্জনা, ডবলডেকার, ট্রাম, মনুমেন্ট, ভিক্টোরিয়া আর হাওড়ার ব্রিজের ছবি ধ্যান করলাম। খুবই অস্পষ্ট ছায়া-ছায়া দেখাল। এরপর কিছুক্ষণ সায়ন্তনীর কথা ভাবতে গিয়ে আতঙ্কে আমার বুক হিম হয়ে গেল। কালও সায়ন্তনীর ছোট কপাল, থুতনি আর কানের বড় বড় লতি ধ্যানে দেখতে পেয়েছিলাম। আজ শুধু কপালটা ধ্যানে এল, বাকিটা একদম মনে পড়ল না। আগামীকাল যদি ধ্যানে সেই কপালটুকুও না আসে!
প্রাণপণে সেই কপালটাকেই যখন স্মৃতিতে ধরে রাখার চেষ্টা করছি তখনই ফটকে শব্দ। ফুলচোরের আগমন।
এই মেয়েটাকে আমি আগেও একবার ফুল চুরি করতে দেখেছি। কিছু বলিনি। আজও ভাবলাম কিছু বলব না। বাগান থেকে কিছু ফুল চুরি গেলে কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। আমার মনের বাগানের সব ফুলই যে চুরি হয়ে গেল! কলকাতা নেই, সায়ন্তনী নেই! তবু যে কী করে বেঁচে আছি!
জানালাটা ভেজিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে পড়ে রইলাম চোখ বুজে।
কিন্তু ফুলচোরের সাহস আজ মাত্রা ছাড়িয়েছে। আমার জানালার নীচে দোলনচাপার গাছের নরম ডগাগুলো ভাঙছে মটমট করে, গন্ধরাজের গাছে প্রায় ঝড় তুলল কিছুক্ষণ, তারপর চন্দ্রমল্লিকার ঝোপ মাড়িয়ে বাগানের পশ্চিমধারে কলাবতীর বনে ঢুকল মত্ত হাতির মতো।
এতটা সহ্য করা যায় না। তড়াক করে উঠে পড়লাম।
বাগানে যখন পা দিয়েছি তখন চারদিক বেশ ফরসা। সবই প্রায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গন্ধরাজ গাছের পাশে ফুলচোরকেও জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। এবং আশ্চর্যের কথা, ফুলচোরও আমাকে বড় বড় চোখে দেখছে। ভয় পাচ্ছে না, পালাচ্ছেও না।
চোর যদি চোরের মতো আচরণ না করে তবে যারা চোর ধরতে যায় তাদের বড় মুশকিল।
চোরের সঙ্গে চোখাচোখি হলে কী বলতে হয় তা ভেবে না পেয়ে আমি অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম! যেন দেখিনি। একটু গলা খাকারি দিয়ে বুঝতে দিলাম যে, সে এখন চলে গেলে আমি কিছু বলব না।