তাই আমি দেমাক করে বললাম, আমি শেখাতে যাব কেন? গানের মাস্টারি করে তো আমাকে পেট চালাতে হবে না। গান শেখা বা শেখানোর দরকারই হয় না আমার। আমাদের বাড়িতে বাইজিবাড়ির মতো সব সময়ে গান বাজনা হয়ও না।
লিচু কতটা অপমান বোধ করল জানি না। তবে মুখটা আরও একটু কালো হয়ে গেল। থমথমে গলায় বলল, কর্ণবাবুকে আমরা আর গান শেখাব না বলেও দিয়েছি।
পাগলা দাশুর নাম যে কর্ণ তা এই প্রথম জানলাম। কেউ তো বলেনি নামটা আমাকে। তবু সেই অচেনা মানুষটা যেহেতু আমার শ্বশুরবাড়ির দিককার লোক সেই জন্য ওঁর হারমোনিয়াম কেনা নিয়ে মনে মনে লিচুদের ওপর একটা আক্রোশ তৈরি হয়েছিল আমার। লিচুকে খানিকটা অপমান করতে পেরে জ্বালাটা জুড়োলা।
আমি ভোরবেলায় উঠি বটে কিন্তু ভৈরবকাকার মতো ব্রাহ্মমুহূর্তে নয়। সেদিন মাকে বললাম, এবার থেকে আমি ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠব, আমাকে ডেকে দিয়ে তো।
উঠে কী করবি?
গলা সাধব।
মা একটু অবাক হলেও কিছু বলল না।
বাবাকে গিয়ে বললাম, আমার একটা স্কেল চেঞ্জার চাই।
বাবাও অবাক হয়ে বলল, কী করবি?
গান গাইব।
বাবা শুনে খুশিই হলেন। বাবা মানুষের কর্মব্যস্ততা পছন্দ করেন। কাজ না থাকে তো যা হোক কিছু করো, পরের কাজ টেনে নাও নিজের ঘাড়ে। সময় যেন বৃথা না যায়।
বাবা বললেন, কিন্তু তোকে শেখাবে কে?
কালীবাবুর কাছে শিখব। ওঁকে তুমি রাজি করাও।
কয়েকদিনের মধ্যেই স্কেল চেঞ্জার এসে গেল। কালীবাবুও রাজি হলেন। উনি অবশ্য অ্যাডভান্সড ছাত্রছাত্রী ছাড়া নেন না, কিন্তু টাকা এবং প্রভাবে কী না হয়!
আমার গলা শুনে কালীবাবু খুব হতাশও হলেন না। বললেন, গলায় প্রচ্ছন্ন সুর আছে। শান দিলে বেরিয়ে আসবে। সকালে আর বিকেলে কম করেও দু’ঘণ্টা করে গলা সেবো।
তা সাধতে লাগলাম। প্রথম দিকে বুকের জ্বালা, আক্রোশ, টেক্কা মারার প্রবল ইচ্ছেয় দু’ ঘণ্টার জায়গায় তিন-চার ঘণ্টাও সাধতে লাগলাম।
কিন্তু গলায় প্রচ্ছন্ন সুর থাকলেও আমার ভিতরে গানের প্রতি গভীর ভালবাসা নেই। তাই গলা সাধার পর খুব ক্লান্তি লাগে। স্ব ছেড়েও দিচ্ছি না।
খবর পেয়ে মল্লিকবাড়ির কর্তা একদিন এসে হাজির। বললেন, তবলাডুগি কোথায়? তবলচি ছাড়া কি গান হয়? দাঁড়াও আমিই পাঠিয়ে দেবখন। আমারটা তো পড়েই আছে।
ভাবী বউমা গান শিখছে জেনে ভারী খুশি হয়েছেন, ওঁর চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। চিনি ছাড়া চা করে দিলাম। চুমুক দিয়ে বললেন, চমৎকার! সবই চমৎকার। কী চমৎকার তা অবশ্য ভেঙে বললেন না।
সেই দিনই ভাবী শ্বশুরবাড়ি থেকে ডুগি তবলা এল। রিকশা থেকে চামড়ার ওপর গদির ঢাকনা দেওয়া পেতলের ডুগি আর তবলা নিয়ে ও বাড়ির চাকর নামল। তবলার সঙ্গে শাড়ির পাড় দিয়ে জড়ানো বিড়ে পর্যন্ত।
দেখে এমন লজ্জা পেলাম!
মল্লিকবাড়ির চাকর সর্বেশ্বর বলল, বাবু তো শিকদার তবলচিকে দিদিমণির জন্য ঠিক করেছেন। কালী গায়েনের সঙ্গে তিনিও আসনে।
শুনে আমার হাত পা হিম হওয়ার জোগাড়। একেই কালীবাবুর কাছে গান শেখাটাই আমার আস্পদ্দা, তার ওপর শিকদার তবলচি! শিকদার হলেন এ জেলার সবচেয়ে ওস্তাদ লোক। কলকাতার সদারঙ্গ আর কজ সংস্কৃতিতেও বাজিয়েছেন। শোনা যায় কণ্ঠে মহারাজের কাছে শিখেছিলেন। দুই বাঘা ওস্তাদ আমার মতো আনাড়িকে শেখাতে আসবেন শুনে আমার গান সম্পর্কে ভয় বরং আরও বাড়ল।
বাড়ির লোকও আয়োজন দেখে কিন্তু কিন্তু করছে। ব্যাপারটা যে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে তা আমিও টের পাচ্ছি। কিন্তু বঁড়শি গিললে আর কি ওগরানো যায়?
আমার রাশভারী দাদা বলল, এ যে একেবারে মাথা ধরিয়ে ছাড়লি রে কাটু!
বাটুল আর চিনিকে পড়াতে আসেন জগদীশ মাস্টারমশাই। এ বাড়ির বাঁধা প্রাইভেট টিউটর। ওঁর কাছে দাদা পড়েছে, আমিও পড়েছি। গান বাজনা শুনে উনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন, এই তো চাই। কোয়ালিফিকেশন যত বাড়ানো যায় ততই মানুষের শক্তি বাড়ে। খুব গাও, গেয়ে একেবারে ঝড় তুলে দাও। সঙ্গে নাচও শিখে ফেলল। ছবি আঁকা, হোমিওপ্যাথি, ইলেকট্রিকের কত যা শিখবে তাই জীবনে কাজে লাগবে।
আমি হাসি চাপবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বাঁটুল আর চিনি এমন বদমাশ যে, হি হি করে ওঁর মুখের সামনেই হেসে ফেলল। সেই দেখে মুখে আঁচল চাপা দিয়েও আমি হাসি সামলাতে পারলাম না।
জগদীশ সরল মানুষ। হাসি দেখে নিজেও হাসলেন। বললেন, ইদানীং একটা গানের হাওঃ এসেছে মনে হচ্ছে। বীরেনবাবুর ভাইপোও গান শিখছে। চারদিকেই গান আর গান। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে প্রত্যেকটা বাড়ি থেকেই গানের শব্দ কানে আসে।
আড়চোখে লক্ষ করি, জগদীশবাবুর জামার পকেট থেকে কাগজে মোড় লটকা মাছের শুঁটকি উঁকি দিচ্ছে। সেইদিকে চেয়ে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। শহরের সব বাড়িতে সবাই গান গাইলে আমার আর গান শেখার মানে হয় না।
একদিন সকালে উঠে গলা সাধতে বসে হারমোনিয়ামটার দিকে ক্লান্তভাবে চেয়ে রইলাম। একদম ইচ্ছে করছে না গলা সাধতে।
ভৈরবকাকা প্রাতঃভ্রমণে বেরোচ্ছিলেন। আমি বললাম, আমিও যাব।
গলা সাধবি না?
একদিন না সাধলে কিছু হবে না। ফিরে এসে সাধনখন।
চল তা হলে।
এক-একটা সময় আসে যখন ঘাড়ে ভূত চাগে। মখটা পাগল-পাগল লাগে। সারা শরীরে খুসখুস একটা ভাব। তখন বেহেড এগ কিয় কমতে ইচ্ছে যায়। মনে হয় ঢিল মারি, চেঁচিয়ে-মেচিয়ে আবোল-তাবোল বলি, হাই উনাদের মতো খুব নাচি, হঠাৎ গিয়ে রাস্তার লোকের কান মলে দিই, হোঃ হোঃ করে হাসিবি হউউ করে কাদি।