তার মানে?
ডানা ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই মন। গত রোববার বাস থেকে পড়ে গিয়ে ডান পায়ে সিরিয়াস স্পেইন। কাস্টিং করা পা নিয়ে পড়ে আছি। মাথার কাছে রেডিয়ো, পাশে টেলিফোন আর কোলের ওপর গুচ্ছের ম্যাগাজিন আর বই। দিনগুলো রবারের মতো টেনে কে যেন লম্বা করে দিয়েছে।
কী কাণ্ড! ভাবলাম তোমার সঙ্গে বিকেলটা কাটাব!
কাটাও না। চলে এসো। আমার ঘরটা তো ভারী স্যুটেবল। নির্জন, নিরিবিলি।
ধুস। এই অফিসভাঙা ভিড়ে কে যাবে বাবা মানিকতলায়!
তুমি কষ্ট করতে শেখোনি কেন বলল তো! কেষ্টদের হয়রান করতে তো খুব ওস্তাদ। এই আহত মানুষটির জন্য কি মায়া হয় না?
হয়। কিন্তু শুধু মায়াই হয়। বেচারা বলে চোখের জল মুছতে ইচ্ছে করে। ছাড়ছি।
আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, এক্ষুনি ছেড়ো না। আমি কী ভীষণ একা বুঝতে পারছ না। তোমার ভয়েসটা অন্তত কিছুক্ষণ শুনতে দাও।
না বাপু, আমি এক দোকান থেকে ফোন করছি, বেশিক্ষণ রিসিভার আটকে রাখা যাবে না। তুমি বরং নয়নাকে ফোন করে তার ভয়েস শোনো। ইয়োর মিসট্রেসেস ভয়েস।
নয়নার ট্রুপ আজ চিত্রাঙ্গদা করছে মহাজাতি সদনে।
টেলিফোনে মৃদু কিন্তু স্পষ্ট একটা ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎ সে শব্দটা জোরালো হল।
মন্দা বলল, তাহলে মধুপর্ণীকে
বৌধায়ন বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও! এ লাস্ট মোমেন্টে একটা গোল ঢুকে গেল রে!…হা কী বলছিলে?
মন্দা বলল, ফুটবল শুনছিলে?
হ্যাঁ। এইমাত্র খেলা শেষ হয়ে গেল।
আমাদের সবার খেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে বৌধায়ন।
তার মানে?
মন্দা একটু লোকদেখানো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, দি গেম ইজ ওভার।
বৌধায়ন হেসে বলে, ফিলজফি হচ্ছে? মাইরি, ওসব বোলো না, খেলা শেষ হলে বাঁচব কী নিয়ে? ভয় দেখাচ্ছ অড্রে হেপবার্ন?
আমি মোটেই হেপবার্নের মতো দেখতে নই। অত রোগা নাকি আমি?
চোখদুটো অবিকল।
যাঃ। মন্দা খুশি হয়ে বলে। বরাবর তাকে অড্রে হেপবার্ন বলে, কমপ্লিমেন্ট দেয় বৌধায়ন। রোগা বলে কি না কে জানে! তবে তার চোখ সুন্দর এটা সে নিজেও জানে।
আসবে?–বৌধায়ন চাতকের গলায় বলে।
মন্দা বলে, না গো। আজ নয় লক্ষ্মীটি। এর মধ্যে একদিন যাব।
আচ্ছা। ভাল থেকো। এখন কোথায় আছ?
চৌরঙ্গি।
ভাল জায়গা। সঙ্গে কে?
কেউ নেই। সুব্রত ছিল, কেটে পড়েছে।
আনওয়াইজ অফ হিম। তুমি একদম একা?
একদম একা। ছাড়ছি।
মন্দা ফোন ছেড়ে আবার ফোন করল। এবারও সমীরণকে।
আপনি আছেন তো?
আছি।
থাকবেন। আমার হয়তো দরকার হবে।
আচ্ছা।
মন্দা টেলিফোনের পয়সা দিয়ে বেরিয়ে আসে।
এদের কার সঙ্গে কবে পরিচয় হয়েছিল তা কিছুতেই মনে পড়ে না মন্দার। সুবীর, সুব্রত, বৌধায়ন, মৃদুলকার সঙ্গে তার আগে বা পরে চেনা হয়েছিল? কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল? কিছু মনে পড়ে না। একজন বন্ধু থেকে আর একজন, তারপর তার থেকে আর একজন, এমনিই এক রিলে রেসের মতো পরিচয় থেকে পরিচয়। একটা সিগারেট থেকে আর একটা ধরিয়ে নেওয়ার মতো।
আজ একা বলে এই সব ভাবল মন্দা। কাউকেই সে কখনও গভীর ভাবে ভাবেনি।
আজ ভাবতে লাগল।
.
০৪.
পা সরাতে বৌধায়ন মুখখানা যথেষ্ট বিকৃত করে। না, তেমন কোনও ব্যথা নেই পায়ে, তবু ব্যথার স্মৃতি আছে, ভয় আছে। আসলে ব্যথা-বেদনার চেয়ে ব্যথা-বেদনাব ভয় বা স্মৃতিই তো মানুষের বেশি।
ইনজেকশন, টিকা, স্টেথােস্কোপ বা থার্মোমিটার সে বরাবর ভয় পায়। এমনকী কেটেকুটে গেলে ডেটল লাগাতেও সে চেঁচামেচি করবেই। এই সব কিছুর সঙ্গে রোগ ও দুর্ঘটনার আবহ মিশে থাকে। আর ও দুটোকেই তার ভয়।
তা বলে কি সে চলন্ত বাসে ওঠে না? বিপজ্জনকভাবে রাস্তা পেরোয় না? দাড়ি বা নখ কাটে না? আর বোগের ওপর তো হাত নেই, তাই ভোগেও। এগিয়ে আসে থার্মোমিটার, স্টেথােস্কোপ, মাঝে মাঝে ইনজেকশনের ছুঁচ। সবই সহ্য করতে হয়, কিন্তু এসব পছন্দ করে না সে। তার মনপ্রাণ প্রত্যাখ্যান করে স্টেথোস্কোপ, থার্মোমিটার, ইনজেকশন এবং ডেটলকে। সে ভুগতে চায় না, আহত হতে চায় না। কিন্তু এও জানে, বেঁচে থাকতে গেলে এসব কিছু না কিছু হবেই।
খুব বিকৃত মুখে বৌধায়ন তার খাট থেকে ভাল পা-খানা বাড়ায়, কাস্টিং আর ব্যান্ডেজে বাঁধা আহত পায়ের দিকে ভয়ের চোখে খানিক চেয়ে থাকে। ব্যথা লাগবে না তো?
খাটের নীচেই একটা প্ল্যাকসোর কৌটো রয়েছে পেচ্ছাপ করার জন্য। সেই কৌটোটার দিকে খুব ঘেন্নার চোখে চায় সে। তার পেটে প্রচুর জল জমে যায়। এত জমে যে প্রায় সময়েই ওই টিনটা ভরেও খানিক উপচে পড়ে। সে এক ঘিনঘিনে অবস্থা। ঘরের মেঝেয় সেই ঘৃণ্য তরল গড়ায়। পরে ঝি বা চাকর কিংবা মা এসে চট চাপা দেয়। সমস্যাটা একটা আরও বড় কৌটোর। কিন্তু কেউ সেই সমস্যাটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।
খাটের ধারে ত্রিশঙ্কুর মতো বসে সে অপেক্ষা করে কিছুক্ষণ। এভাবে বেঁচে থাকার মানেই হয়। গতকাল এক্স-রে হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, স্পেইন, তবে কিনা বেশ জটিল স্পেইন। পেশির কিছু তন্তু ছিড়েছে হয়তো, শিরা কেটে গেছে। কে জানে কী! ডাক্তাররা এক রহস্যময় জাতি, তারা কখনও স্পষ্ট করে কিছু বলে না। মন্ত্রগুপ্তিতে তাদের পাকা ট্রেনিং দেওয়া হয় বোধহয়। মন্ত্রীদের মতো তারাও কি মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিয়ে তবে চিকিৎসা শুরু করে? বছরখানেক আগে জ্বর আর কাশিতে কাহিল বৌধায়ন ধরেই নিয়েছিল, টি বি। ডাক্তারকে যত বলে স্পষ্ট করে বলুন কী হয়েছে, ডাক্তার ততই মৃদু হেসে বলেন, “অত ভাবছেন কেন? আমি তো আছি।’