তুমি রেগে যাওনি তো!
মন্দার মুখভাবে রাগই ছিল। থমথম করছে।
বাইরে এসে সুব্রত সিগারেট ধরিয়ে বলল, তোমাকে একটু এগিয়ে দেব কোনও দিকে?
না।
তা হলে তুমি রেগেছ। আমার ওরকম করে বলা ঠিক হয়নি।
হঠাৎ ফিক করে হেসে মন্দা বলল, বোকা। কেন? তুমি বোকা।
জানো না মেয়েরা অনেক সময় ওইসব স্যাডিজম পছন্দ করে।
আমিও তা জানি।–বলে সুব্রত দাতে ঠোঁট কামড়ে খুব চালিয়াতের মতো হাসে।
জানো?
জানি। আর এও জানি যে তুমি হচ্ছে সেই ধরনের মেয়ে যারা ফিজিক্যাল টর্চার পছন্দ করে। দে ওয়ান্ট টু বি বিটন, সাফোকেটেড, ইভন রেপড়!
রুদ্ধশ্বাসে ‘ফের মার খাবে!’ বলে মন্দা তেড়ে গেল।
সুব্রত হাসতে হাসতে একটা দারুণ ভিড়ের বাসে চুম্বকের মতো সেঁটে উঠে গেল চোখের পলকে।
আর তারপর থেকে ভারী একা লাগতে লাগল মন্দার। ভীষণ একা।
একা গায়ে গায়ে ভিড়ের মধ্যে উদাস হাঁটতে হাঁটতে মন্দা ভাবে, ঠিকই বলেছিল সুব্রত। যত ভিড় বাড়ছে, তত যেন একা হয়ে যাচ্ছে মানুষ। শুধু যে একা তা-ই নয়, মন্দার সব সময়ে মনে হয় কেউ তার দিকে লক্ষ রাখছে, পিছু নিচ্ছে, সুযোগের অপেক্ষায় আছে।
বিকেলটা বড্ড মন-খারাপের সময়। আলো মরে যায়, মন মরে যায়, শ্বাসের বাতাসে কম পড়ে। চারপাশে যেন এক অদৃশ্য গরাদ চেপে ধরে।
অস্থির মন্দা একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে ফোন করল। ফোন করার আগে অনেকগুলো নম্বর মনে মনে মুখস্থ বলল। নম্বরের সঙ্গে নাম। কিন্তু কারও মুখই চোখে ভেসে ওঠে না যে! বাধ্য হয়েই সে প্রথম ফোনটা করল তার বাবার অফিসে।
কে? সমীরণবাবু?
হ্যাঁ।
আপনি আর একটু অফিসে থাকুন। হয়তো আপনাকে আমার দরকার হবে। আমি আবার ফোন করব।
আচ্ছা।
এবার মন্দা ফোন করল মৃদুস্বরে অফিসে। মৃদুল ছোট কোম্পানির অ্যাকাউন্টসের বড় কর্তা। অনেকক্ষণ অফিসে থেকে কাজ করে। পাওয়া গেল।
আসবে? ফ্রি আছ?
মৃদুল হেসে বলে, আমি তো ফরগাটন মন!
কে বলল?
নই? অনেকদিন খোঁজ নাওনি।
তুমিও নাওনি।
পাল্টি দিচ্ছো?
বিরক্ত হয়ে মন্দা বলে, আসবে কি না বলো। আমার ভীষণ লোনলি লাগছে।
আমি আজকাল অফিসের পর একটু ককটেল করি। তোমার চলবে?
কেন, আমি কি খুকি নাকি? শুধু দুধ খাই বুঝি!
মৃদুল মৃদু হেসে বলে, জানি। কিন্তু আমার সঙ্গে কয়েকজন লোক থাকবে, অল বিজনেস পিপল। অ্যান্ড দেয়ার উইল বি সিরিয়াস ড্রিংকিং। পারবে তো তাল রাখতে?
অপমানে মন্দার মাথা ঝাঁ করে উঠল। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় সে বলল, ইউ আর অ্যাভয়ডিং…অ্যাভয়ডিং…স্কাউড্রেল।
চটছ কেন মন? জানো তো আমাদের চাকরি শুধু অফিসের মধ্যে নয়। সারাদিনই আমরা চাকরি করি—অফিসে, ক্লাবে, রেস্তোরাঁয় পার্টিতে, ইভন সামটাইমস ইন বেডরুমস। আমাদের চাকরি বড্ড ছড়ানো, বড় সর্বনেশে। আজ বিকেলের ককটেলটাও ওই চাকরিই। নইলে কি তোমার সঙ্গে একা হতে লোভ হয় না? রাগ কোরো না মন।
মন্দা উদ্যত চোখের জল গোপনে রুমালে মুছল। ফিস ফিস করে বলল, তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাই না। পোপোজাল উইথড্র করে নিচ্ছি।
তোমার গলার স্বরটা পাল্টে গেল কেন মন? তুমি সিরিয়াসলি দুঃখ পাওনি তো? আরে, আমি সত্যি বলছি আজ তুমি এলে একটুও অসুবিধে হবে না। তুমি কোথায় আছো বলল, আমি গিয়ে তোমাকে তুলে নিচ্ছি।
না। আমি তোমাকে একা চেয়েছিলাম।
মৃদুল খুব দ্বিধায় পড়ে বলল, একা? সেইটিই তো গোলমাল হচ্ছে মন।
আচ্ছা, ছাড়ছি।
আমি কি ভাল লোক মন?
হঠাৎ একথা কেন?
সত্যি বলো তো আমি কেমন!
মন্দা হাসল, বলল, ভাল নও।
মৃদুল খুব দুঃখের গলায় বলে, আমারও তাই মনে হয়। আমি বোধহয় একটা স্কাউড্রেল!
মন্দার খুব লজ্জা করছিল। ফোনে সে একটু আগে যে উত্তেজিতভাবে কথা বলেছিল সেটা দোকানের লোকটা লক্ষ করেছে। তাই সে সাবধান হল। বলল, না। তুমি, তোমরা সবাই বোধহয় খুব ভাল। আসলে আমিই শেমলেস।
ওকথা বোলো না মন। তোমার একটুখানি সঙ্গ পাওয়ার জন্য কত ছেলে পাগল!
তুমি তো তাদের দলে নও।
আমি তাদের দলপতি।
বাজে বোকো না। ছাড়ছি।
তা হলে কবে বলো?
কী কবে?
তোমার সঙ্গে একা!
তোমার তো সময় নেই। বেডরুমেও চাকরি করতে হয় বলছ।
একদিন চাকরি করব না। কবে বলো।
মন্দা রুদ্ধকণ্ঠে বলে, জানাব। একদিন জানাব।
ফোন রেখে দিল। আবার রিসিভার তুলল। মন্দার পিছনে কে যেন সামান্য একটু বিরক্তির শব্দ করল, ইস। মন্দা ঘাড় ফিরিয়ে তার বিখ্যাত বড় বড় চোখে ছেলেটাকে দেখল। ফোন করবে বলেই বোধহয় দাঁড়িয়ে আছে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে পিছনে কে জানে? হয়তো শুনছিল কথাবার্তা।
মন্দার রাগ হল না। বরং খুব ভাল মানুষের মতো রিসিভার এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনি ফোন করবেন? করে নিন না! আমার তাড়া নেই।
ছেলেটা ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলল, না না। আপনি বরং
বেশ ছমছমে কাচা ছেলে। তেমন লম্বা নয়, খুব বড়লোকের ছেলেও নয়। একটু নার্ভাস প্রকৃতির কি? মন্দা চেয়ে দেখল, তারপর মৃদু হেসে বলল, নিন।
ছেলেটা আপত্তি করল না। মন্দা ততক্ষণ চারদিকে চেয়ে লোকজন দেখতে লাগল।
ছেলেটা ফোন নামিয়ে বলল, লাইন পাচ্ছি না। আপনি করে নিন।
মন্দা টেলিফোন তুলেই ভাবল, এই বিকেলে বৌধায়ন কি বাড়িতে থাকবে? বৌধায়ন অবশ্য
অবশ্য চাকরি করে না, কিন্তু বেকাররাই তো সবচেয়ে বেশি বাইরে ঘোরে।
বৌধায়ন ছিল এবং সে-ই ফোন ধরে বলল, ডাকছ? আয় হায় রে পরান সখী, পাখি নউ তার। ঠাই উড়ি যাই।