মন্দা অবশ্য ঘাটাল না। বলল, আমি যাচ্ছি। আপনি অন্তত ছ’টা পর্যন্ত দেখে অফিস বন্ধ করবেন। আই মে নিড ইউ। টেলিফোনের কাছে থাকবেন। সুব্রত, লেটস গো।
ফরসা লম্বা ছেলেটার সঙ্গে মন্দা বেরিয়ে গেল।
একটা বড় শ্বাস ছেড়ে বাইরের অফিসে বসে রইল সমীরণ। রায়বাবুর ঘর বন্ধ করে চাবি নিয়ে গেছে মন্দা।
.
০৩.
সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে সুব্রত বলল, আমি আলিয়স ফ্রঁসে যাব। তুমি?
মন্দা বলল, বিকেলটা ভারী বিচ্ছিরি! বিকেলবেলাটায় আমার একদম একা থাকতে ভাল লাগে না।
এইটুকুই মন্দা বলল। কিন্তু কথাটার মধ্যে একটু হ্যাংলাপনা আছে, আর আছে আমন্ত্রণ।
সুব্রত তার সুন্দর দাঁতে আর ঠোঁটে অদ্ভুত একটু হেসে বলে, সেই বেলা বারোটা থেকে দু’জনে গা ঘষাঘষি করছি। আমার আরও একটু কমপানি দিতে আপত্তি নেই।
বলে সুব্রত তার ডান কজিতে ঘড়ি দেখল। ঘড়িটা একটু বিটকেল রকমের। ওপরে কেবল ঘোর লাল রঙের কাচ, একটা ছোট্ট বোতাম টিপলেই সেই লাল কাচের ভিতর আলোর অক্ষরে ঘন্টা আর মিনিট ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। ঘড়ি দেখে সুব্রত বলল, সাড়ে ছ’টায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। আরও ঘন্টাদেড়েক আছে।
মন্দা অভিমান করল না। কিছুটা অসহায় ভাবে বলল, আ হ্যাভ ফিনিশড এভরিথিং। পড়াশুনো, নাচগান, ল্যাংগুয়েজ–অল সর্টস অফ থিংস। আর কী করার আছে বলো তো? কী নিয়ে এনগেজড থাকা যায়?
সুব্রতর বদ অভ্যাস হল, কথায় কথায় সে নিজের নাকটা ধরে মোচড় দেয়। এখনও দিল। মুখে সেই হাসি। বলল, গো সামহোয়্যার, বিলাতে বাপ্পার এগজিবিশন হচ্ছে। যাও না!
দেখা হয়ে গেছে।
তাহলে বিজিতকে একটা টেলিফোন করো। চলে আসবে।
বিজিত বড় সিরিয়াস টাইপের হয়ে গেছে। ওর রিসেন্ট প্রবলেম কী জানো?
কী?
হাউ টু বি এ মার্কসিস্ট উইদাউট বিয়িং এ কমিউনিস্ট। তাছাড়া হিজ জব ইজ ইটিং হিম। প্রায়ই সন্ধে সাতটার আগে বেরোতে পারে না।
তাহলে কী করবে?
ভাবছি গাড়িটা থাকলে হত।
সুরেন ব্যানার্জি রোডে বেশ ভিড় এখন! ভেজা রাস্তা থেকে চটির সঙ্গে কাদা ছিটকে আসছে। সুব্রত গ্রাহ্য করে না। কিন্তু মন্দা পিছন দিকে পায়ের কাছে নিজের দামি শাড়িটার অবস্থা ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে নিয়ে বলল, নইসেন্স! গাড়িটা থাকলে
গাড়িটা কী হয়েছে?
একটা কপট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মন্দা বলে, অয়েল ইজ সো ডিয়ার! সো ড্যাড ডিক্লেয়ারস, নো কার। দেখো শাড়িটার অবস্থা।
সুব্রতর গলার স্বর ভীষণ ভদ্র। সবসময় একটা বিশেষ পর্দায় বাঁধা গলা। সেই মলমের মতো গলায় বলে, সবাই সাফার করছে, তুমি একলা নয়। তোমাকে অনেক শাড়ি আছে।
তা তো বলবেই!
সর্বাণীকে টেলিফোন করলে কেন? ওর সঙ্গে তো তোমার কাট হয়ে গেছে।
ওঃ আই হেট হার সো মাচ! আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুবীরের কথা জানতে চাইছিলাম। সুবীর আমাকে ফ্রাংকফুর্ট আর লন্ডন এয়ারপোর্ট থেকে চিঠি দিয়েছে। ওয়াশিংটনে পৌছেই চিঠি দেবে লিখেছে। সর্বাণীকে শুধু লন্ডন থেকে দিয়েছে। আমি জানি সুবীর ওকে বেশি কিছু লেখেনি! ও অনেক কথা বাড়িয়ে বলল!
কী করে বুঝলে?
ট্রুথ ইজ লাইক এ ফ্র্যাগরান্ট ফ্লাওয়ার। গন্ধ পাওয়া যায়। ও বলল, সুবীর নাকি ওকে মিস করছে। উড ইউ বিলিভ?
সুব্রত হেসে বলে, নয় কেন? আমি তো সব সময়ই কাউকে না কাউকে মিস করছি বলে মনে হয়।
মন্দা খুব গম্ভীর হয়ে বড় বড় বিখ্যাত চোখে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বলল, এখন কাকে মিস করছ?
অল দি অ্যাবসেন্টিজ। যারা কাছে নেই তাদের সবাইকে। যেমন তুমি সুবীরকে মিস করছ।
মন্দা গম্ভীর হয়ে বলে, ইউ আর জেলাস।
আরে না। জেলাসি ইজ অল বলস! ওসব নয়। ঠাট্টা করছিলাম। সুবীর হয়তো সত্যি সত্যিই সর্বাণীকে মিস করছে, তোমাকেও মিস করছে, এমন কি হতে পারে না?
হবে না কেন? আমি তো তা বলিনি। কিন্তু সর্বাণীকে কি সুবীর সিরিয়াসলি নেয়? সর্বাণী তো বোঝে না যে সুবীর ওকে কত বোকা ভাবে।
সুব্রত আর একবার বোম টিপে তার ঘড়িতে উদ্ভাসিত সময় দেখে নেয়। একটু উদাস হয়ে বলে, আমি যখন প্রথম জার্মানিতে যাই তখন আমি আমার বাড়ির বেড়ালটাকেও মিস করতাম। ইট হ্যাপেনস।
মন্দা জেদবশত বলে, কিন্তু আমি খুব ভাল জানি, সুবীর সর্বাণীকে মোটেই মিস করছে না।
সুব্রত মৃদুস্বরে বলে, নাউ ইউ আর বিয়িং জেলাস।
মন্দা রাগের গলায় বলে, জেলাসি ইজ অল
বলেই হেসে ফেলে। কথাটা শেষ করে না।
সুব্রতই বলে দেয়, বলস অল বলস। তুমি কি সুবীরকে মিস করছ মন?
এ লিটল। দিস মাচ
বলে মন্দা ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে সরষের মাপ দেখায়।
দেন ইউ আর নট জেলাস।
থ্যাংক ইউ।
কিছু খাবে নাকি? অনেকক্ষণ হেঁটেছ।
না, ময়দানে গিয়ে বসা যেত, কিন্তু যা জল!
সুব্রত আবার তার আলো-ঘড়ি দেখে বলে, সময়ও নেই। সরি।
ইউ আর অ্যাভয়ডিং মি!
আরে না। ফাদার সাইমন কালই মাদ্রাজে চলে যাচ্ছেন। ইটস এ ফেয়ারওয়েল ডিনার। আফটার অল আই অ্যাম গ্রেটফুল টু হিম। না গেলেই নয়।
যাবে যাও। কিন্তু ডোন্ট লেট মি ফিল অ্যাবানডনড! আ অ্যাম সোপজেজড বাই বোরডম।
তুমি সর্বাণীকে একটা আনক্যানি ফিলিং-এর কথা বলছিলে। ইজ ইট টু অর জাস্ট এ গিমিক?
মন্দা হেসে বলে, ওসব বলতে হয়। ওকে একটু নার্ভাস করে দিচ্ছিলাম।
ইউ ডিডনট সাউন্ড লাইক জোকিং।–সুব্রত গভীর হয়ে বলে।
মন্দার চোখদুটো হঠাৎ জ্বালা করে। চোখের পাতা ভিজে আসে। কান্না-টান্না নয়। খুব রাগ হলেও মন্দার এরকম হয়। সে জবাব দিল না।