এই দেখা না-দেখার ব্যাপারটা সমীরণ ভালই বোঝে। তার অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, প্রতিদিন যারা তার দিকে তাকায় তারা সবাই তাকে সবসময়ে দেখে না। তাকানো আর দেখা দুটো আলাদা ব্যাপার।
মন্দা টেলিফোনে বলল, ওঃ, আই ফিল সো জামপি। নট দ্যাট আম স্কেয়ারড… ওঃ, নোঃ হিঃ হিঃ… নটি নটি…
সমীরণ কান ভরে শোনে। কী নিখুঁত ইংরিজি উচ্চারণ! শুনতে শুনতে ঢোক গিলল সে। মনে হল চমৎকার ওইসব ইংরিজি শব্দ তার পেটের মধ্যে চলে গেল।
মন্দা একটা ছাপা তাঁতের শাড়ি পরেছে। সমীরণ বোকা নয়। সে জানে তাঁতের হলেও শাড়িটার ছাপা একসকুসিভ। মেরেকেটেও দু’-তিনশো টাকা দাম হবে। হালকা জাম রঙের ওপর হলুদ সবুজ সব নকশা। নানা রঙের ছিটে ছড়িয়ে আছে। ঝলমল করছে। দেখে দেখে ঢোক গেলে সমীরণ। সবটাই তার পেটে চলে যায়। শাড়ির নকশা, রং, ইংরিজি উচ্চারণ। গোটা মন্দা।
মানুষ তো শুধু শরীরটা নয়। তার শব্দ ভাব-ভঙ্গি চোখের দৃষ্টি গায়ের রং পোশাকের বাহার এইসব মিলিয়ে এক-একটা মানুষ নিজের চারধারেও অনেকটা জায়গা দখল করে নিতে পারে। আসলে বাহার চাই। যার বাহার যত কম সে নিজের চারধারে তত কম জায়গা দখল করতে পারে। মানুষে মানুষে এই জায়গা দখলের জব্বর লড়াই চলেছে। সমীরণ দেখতে পায়, মন্দা অনেকখানি জায়গা নিয়ে ফেলেছে।
সমীরণের নিজের চারধারে জায়গাই নেই। বলতে গেলে সে নিজের শরীরটুকুতেই শেষ। তার বাইরে তার আর তেমন কোনও প্রভাব নেই।
মন্দা টেলিফোনে কি ভূতের গল্প বলছে? এমনিতেই সমীরণ ইংরিজিটি খুব ভাল বোঝে না, তাতে আবার সাহেবি উচ্চারণ। তবু আন্দাজ পায় মন্দা ভূতের কথাই বলছে, ওঃ, ইট ওয়াজ সো ঘ্যাস্টলি! আই হ্যাড আনক্যানি ফিলিং। সামওয়ান ওয়াজ শ্যাডোয়িং মি অল অ্যালং…
ভূতই। তাছাড়া কীই বা হবে। এ ব্যাপারে মন্দার সঙ্গে তার নিজের একটা মিল আছে। যখন সে পলাশিতে থাকত, তখন রাত-বিরেতে কত গাঁ গঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছে একা একা, রাতের মাঠ পেরিয়ে গেছে, মাঝরাতে জ্যোৎস্নায় গিয়ে বসেছে দাওয়ায়, তখনও ভূতে বিশ্বাস ছিল প্রবল, কিন্তু ভয় ছিল না। তারপর কলকাতায় এসে নানাজনের পাল্লায় পড়ে সে শিখেছে যে ভূত-টুত কিছু নেই। এই বিজ্ঞানের যুগে ভূত থাকতেই পারে না। সে কথাই সে আজকাল বিশ্বাস করে। কিন্তু যত সে ‘ভূত নেই’ বলে বিশ্বাস করে ততই তার মধ্যে আজকাল ভূতের ভয় দেখা দেয়। এই কদিন আগে দিনদুপুরে একটা বোেঝাই বাসের ঠাসাঠাসি ভিড়ে বসে সে অফিসে আসছিল। হঠাৎ তার মনে হয় ভিড়ের ভিতর থেকে ইঁদুরপানা মুখের একটা লোক খুব খোঁচানো দৃষ্টিতে তাকে অপলক দেখছে। সে দেখা যেন গিলে খাওয়া, ভস্ম করে ফেলা, ঘেন্নার কাদা ছিটিয়ে দেওয়া। সমীরণ লোকটাকে যে স্পষ্ট দেখেছে তাও নয়। কেবল মনে হয়েছে রড ধরে কাটা পাঁঠার মতো ঝুলছে যেসব নরদেহ তাদেরই ভিতরে কেউ যেন! অথচ স্পষ্ট বুঝতে পারেনি কে। যখন টের পেল তখন খুব ভাল করে সকলের মুখ নজর করে দেখেও কিছুতেই সেই মুখটাকে চিনতে পারল না। সেদিন ভারী কাটা দিয়েছিল গায়ে। অনেকক্ষণ ধরে চামড়ার নীচে যেন সরষেদানা গড়িয়ে যেতে লাগল। সেই বলতে গেলে প্রথম ভূতের ভয় হল তার। গদাধরবাবুর বাড়ির একতলায় সে একটা ছোট ঘরে থাকে। পুরনো বাড়ি, নোনায় দেয়ালের পলেস্তারা পাঁচড়ার মামড়ির মতো উঠে আসছে। দগদগে ঘা বেরিয়ে আছে ঘরটার সর্বাঙ্গে। সেই ঘরে এক ছুটির দুপুরে চৌকিতে চিতপাত হয়ে শুয়ে সে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। এমন কিছু নির্জনও ছিল না। দুপুরটা। পাশের ঘরেই রেডিয়োতে নাটক হচ্ছে। উঠোনের কলতলায় গদাধরবাবুদের তরুণী ঝি বাসন মাজতে বসলেই ভাড়াটে সত্য গাঙ্গুলির মেজো ছেলে প্রায়দিনই হাতে আয়না আর ছোট কাচি নিয়ে গিয়ে রোদে বসে সাবধানে গোঁফের জঙ্গলে কাচির ডগা ঢুকিয়ে পাকা গোঁফ গোড়া থেকে কেটে ফেলে। মেজো ছেলে সীতাংশুর চুল দাড়ি অল্প বয়সেই পেকেছে, একটু মাথা-পাগলা মতে। বিয়ের জন্য হন্যে। গদাধরবাবুর তরুণী ঝির সঙ্গে নানা কথা বলে মনের দুঃখ ভোলে। সেই দুপুরে তাদের প্রেমালাপও কানে আসছিল। এর মধ্যে হঠাৎ তার মনে হল, ঘরের দেয়ালের একটা জায়গায় যেন ঠিক হুবহু একটা মানুষের আকৃতির ছাপ। যেন জলে ভেজা কোনও মানুষ খানিকক্ষণ দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছে। সেই দেখে আঁতকে উঠল হঠাৎ সে। কেবলই মনে হতে লাগল, নিশ্চয়ই কখনও কাউকে খুন করে এই দেয়ালের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল। এতদিন বাদে সেই লোকটার শরীর দেয়াল চুইয়ে ভেসে উঠেছে। ধারণাটা এমনই বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল তার যে সে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল। খুব ভয়ে ভয়ে ছিল ক’দিন। নিজের পয়সায় চুন কিনে এনে শেষ পর্যন্ত জায়গাটা চুনকাম করে সে। আজকাল সে ভূতের ভয় পায়।
মন্দা যখন টেলিফোন নামাল তখন সমীরণ ঘোর অন্যমনস্ক হয়ে ভূতের ভয়ের কথা ভাবছে।
মন্দা বলল, আপনি এতক্ষণ অফিসে ছিলেন না?
সমীরণ চমকে উঠে বলে, না, আউটডোরে যেতে হয়েছিল।
ও। কিন্তু অফিস ফাঁকা রেখে যাওয়াটা ঠিক নয়। আমি চারটের সময় এসে দেখেছি দু’জন ভদ্রলোক বসে ছিলেন। পার্টি এসে ফিরে যাওয়া কি উচিত?
মন্দা কিছুমাত্র রাগ দেখাচ্ছে না, খুব ভালমানুষের মতো কথাটথা বলছে আর তার মুখের দিকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ভারী ঠান্ডা আর নিষ্ঠুর চোখ মন্দার। একটু অস্বস্তি বোধ করে সমীরণ। দুপুরে টেনে ঘুম দিয়েছিল, মুখচোখ নিশ্চয়ই রসস্থ আর ভাব-ভার। দুপুরে ঘুমোলে সেটা মুখের চেহারায় ধরা পড়বেই! তাছাড়া রোদে জলে ঘোরা চেহারাও তার এখন নয়।